
|| ইসলামো-ফিলিয়া ||
হুমাইয়া ছালছাবিল ফাইজা
[চার]
মন থেকে নোমান সিদ্ধান্ত নিয়েছে মৃণালের বাসায় আর কখনো যাবে না, যদি এ তার মনের বাচ্চামি গুমোট হয় তবে তাই। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতেও সে আর ওখানে যাবে না, দরকার পড়লে নিজের বাসায় ডেকে নেবে অথবা অন্য কোথাও দেখা করবে। গানের দলের কাজ জুম অ্যাপের ভার্চুয়াল স্ক্রিনেই সেরে নেবে। তবে এ কথা সরাসরি মৃণাল অথবা দলের আর কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না। যার ঘরে আলমারির সর্বোচ্চ তাকে অথবা বুকশেল্ফের অজস্র বইয়ের মাঝে কুরআন নামক মহাগ্রন্থ স্থান পায়নি তার বাসায় যেতে একটা গভীর অপরাধ বোধ কাজ করছে, অমোঘ মন খারাপ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
মুসলমানের ঘরে কুরআনের শূন্যস্থান মেনে নেয়া যায় না।
বাঙালির তথাকথিত হাজার বছরের সংস্কৃতির মধ্যে কুরআন মাজিদকে ঘরের সবচেয়ে উঁচু স্থানে কাপড়ে ঢেকে রাখাটাও আবশ্যক রীতি; নোমান বিশ্বাস করে এই রীতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হলেও কুরআনুল কারীমের মুসহাফ বাড়িতে থাকা বাধ্যতামূলক। দ্বীনের বিধিনিষেধ যদি কেউ নাও বা মানে। ডিএনএর আদি নকশায় মানুষের খোদাভীরু চেতনার গল্পকথা আজো জীবিত আছে, ঝড়ের রাতে জিভের আগালে আওড়ানো দোআ ইউনুসের মতো।
রাত সাড়ে দশটার দিকে কনসার্টে মঞ্চে কেমন আয়োজন করা হবে তার আলোচনা শেষে বাসায় ফিরছে সকলে। নোমান ইচ্ছে করে সারিয়ে তোলা গিটারটাকে মৃণালের বেডরুমে রেখে এসেছে, অজুহাত হিসেবে বলেছে কাটা হাতে গিটারের ভার আর তুলতে মন চাইছে না। গাছতলায় বসা মৃণালের বাউল মনে প্রশ্ন জেগেছিল বটে সদ্য কাটা হাতে সকালেই যে ছেলে তারছেঁড়া গিটার হাতে বেরোলো, সে রাত হতেই কাটা হাতের দোহাই দিয়ে প্রাণপ্রিয় গিটারটাকে রেখে চলে গেল! নোমানকে এর আগে কখনো গিটার বিহীন অবস্থায় হাঁটতে দেখেনি কেউ, আজ দেখতে হবে ভাবতেই শ্বাস কেঁপে উঠছে অতর্কিত ভয়ে। পরে ভাবলো এ আর এমন কী ব্যাপার। বন্ধুর বাড়িতে রেখে যেতেই পারে, হয়তো কাটা জায়গার ব্যথা কনুইয়ে ছড়িয়েছে।
পাশাপাশি হাঁটছে নোমান আর প্রমী, বাকিরা চলে যাবার পর প্রমী দাঁড়িয়ে থেকে ইশারায় বলতে চেয়েছিল এখন অন্তত কিছুক্ষণ একান্তে সময় কাটানোর অনুমতি পাওয়া যায় কি? সাঁই দিয়েছিল নোমান মাথা নাড়িয়ে।
বন্ধুরা সব ততক্ষণে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মিশে গেছে অনেক দূরে, রাস্তা খুব বেশি ফাঁকা নয়; আশেপাশে জ্যামের দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে রেহাই পাওয়া মানুষের আনাগোনা রয়েছে।
—বাড়ি ফিরবি কখন, রাত তো অনেক হলো। এবার তোর বাড়ি যাওয়া উচিত।
নোমান বলল ফুটপাতের চিরাচরিত কৃষ্ণচূড়ার ডালে চোখ রেখে।
—ফিরব, চিন্তা করো না। তোমার সাথে থাকলে আমি নিরাপদ বোধ করি, আরো কিছুক্ষণ না হয় নিরাপদ বোধ করার সুযোগ আমায় দিলে।
—এই ‘চিন্তা করো না’ ‘তোমার সাথে’ আবার কী, কতবার বলেছি তুমি তুমি করে ডাকবি না আমাকে। আমার ভাল্লাগে না। অস্বস্তি হয়। তুই করে ডাকবি।
—ওহ।
—ওহ আবার কি, যেটা বলেছি সেটা শুনবি। না হলে তোর সাথে কথা বলা আমার জন্য নিষেধ।
—এটা কিন্তু ঠিক না। লঘু পাপে গুরু দন্ড দিচ্ছো?
—আবার ‘দিচ্ছো’। ‘দিচ্ছিস’ বল!
প্রমী আর কিছু বলল না। নীরব ভাষায় অভিযোগ করতে থাকল, যা নোমানের কান অবদি পৌছালেও হৃদয়ে কড়া নাড়ল না।
রাস্তার ধারের বাঁশের তৈরি বেঞ্চে দুজনে বসেছে, নক্ষত্র গুনছে মনে মনে বোকার মতো। শখের বশে নিজেকে নির্বোধ প্রমাণের চেষ্টা একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাই বোধ হয়, কারণ নক্ষত্র পানে চেয়ে চেয়ে আগেকার মানুষ পথ চিনে নিতো। হয়তো তারা গুনতে যেয়েই এই পথ চেনার পদ্ধতি বের হয়েছিল। নোমানও পথ খুঁজছে, সরল সাদাসিধে পথ। দুনিয়াবী মারপ্যাঁচের বালাই নেই যেখানে। নাজায়েজ প্যাশনের প্রতি আজ্ঞাবহ থাকতে গিয়ে কম পেরেশানি পোহায়নি সে, নিখোঁজ হয়েছে তার স্বভাবজাত জায়েজ জীবনবোধ, আল মালিককে চেনার মূল্যবোধ।
—আর মৃণালের বাসায় আসবে না, তাই না?
চমকিত চোখে প্রমীর দিকে তাকাল নোমান, অনন্য বিস্ময় তার ভ্রুর মাঝে।
—তুই কি করে বুঝলি? আমি তো কাউকে কিছু বলিনি এ কথা।
—তোমার চোখ দেখেই বুঝে ফেলেছি। আচ্ছা তাহলে গানের কাজ কীভাবে করবে?
মৃদুমন্দ হেসে নোমান উত্তর দিলো,
—অনলাইনে, ওটাই বেস্ট হবে।
—এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ কী বলো তো?
—তুই আমার কথা শুনবি না তাই না? ঢঙ করে তুমি করেই ডাকবি?
—অন্য কথা বলো শুনব। এটা শুনতে পারব না।
ধীরে ধীরে চাঁদের আবাহন শোনা যাচ্ছে জোছনার নিবিড়তম আগমনে, ফুটপাতে ফকিরের দল পয়সা গুনছে হতাশাগ্রস্ত শ্বাস প্রশ্বাসে।
পেট ভরেছে তাদের এক চামচ পুঁজিবাদে। এখন চোখে মৃত্যু। শীত এসে ঘুম পাড়ায় জোছনার আদরে। এক ফকিরের নিথর রাঙা শরীর নোমানের নয়নে একটা বৃহৎ রুধির নদীর জন্ম দিয়েছে। সে নদীর পাড়ে গোলটেবিলে টক শোর আয়োজন করছে এ সমাজের গণ্যমান্য ঠিকাদাররা। যাদের আঙুল হারিয়ে ফেলেছে জিকিরের সুখ, জীবনের সকল অসুস্থ অর্জন করেছে তাদের হৃদয়কে বধির-মূক।
—তোর চোখ দেখে আমিও কিন্তু একটা কথা বলতে পারি।
নোমান বলল প্রমীকে লক্ষ করে।
—কী কথা?
—তুই আসলে সপ্তাহে একদিন করে কুরআন পড়িস না, অনেক বছর আগে পড়তিস।
আড় চোখে দোষীর বেশে তাকালো প্রমী। ভয়ঙ্কর অবাধ্য সৌন্দর্যে গেঁথেছে তার ঠোঁট, কপাল ছোঁয়া নরম চুল, গালের ফোলা অংশ এবং চোখা নাকে পরা ছোট্ট নাকফুল। কিন্তু নোমানের প্রমীর দিকে খেয়াল নেই, ওর প্রতি ভীষণ বেখেয়ালি সে এই মুহূর্তে। কথাটা বলেই যেন কোথাও একটা নিজেকে খুঁজছিল সে।
ভাবছিল এক মনে বুকের প্রাচীন পাথর সরিয়ে, ফকিরের তসবীহ ছুঁয়ে থাকা বিষণ্ন ডান হাত তার হৃদয়ে কতখানি রক্তক্ষরণ করেছে, নাকি ছিনিয়ে নিয়েছে দুনিয়াবী শরাবের পেয়ালায় চুমুক দেয়ার সাধকে।
চলবে…