যুদ্ধ, নিষ্পেষণ ও আশা: ফিলিস্তিন সংকটের নতুন মোড়

যুদ্ধ, নিষ্পেষণ ও আশা: ফিলিস্তিন সংকটের নতুন মোড়

হাছিব আহমদ
শিক্ষার্থী,মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

আসলে ফিলিস্তিন সংকট এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলমান এক মানবিক, রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কট ও কোটি মাজলুমের আর্তনাদ । এটি কেবল একটি ভূখণ্ডের মালিকানা নিয়ে সংঘর্ষ নয়; বরং এটি জাতিগত  ধর্মীয় নিপীড়ন, ঔপনিবেশিকতা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘনের জটিল এক অধ্যায়ের ইতিহাসের চিত্র। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধের নতুন মোড়, নিষ্পেষণের ভয়াবহতা এবং সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনি জনগণের অদম্য আশা বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে এই সংকট নতুন মোড় নিয়েছে, যেখানে যুদ্ধের বিভীষিকা, নিষ্পেষণের তীব্রতা এবং আশা—এই তিনটি বিষয়ই সমানভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। চলতি বছরে এসে এই সংকট নতুন মাত্রা ও মোড় নিয়েছে, যা যুদ্ধ, নিষ্পেষণ এবং আশার মিশ্রণে একটি জটিল চিত্র, ফিলিস্তিন সংকটের শেকড় ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ঘটনাবলীর মধ্যে নিহিত। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা এবং এর ফলে সাত লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনির বাস্তুচ্যুতি (নাকবা)—এসব ঘটনাই আজকের সংকটের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। এরপর ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা দখল এবং ক্রমাগত বসতি স্থাপনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমিতে পরাধীন করে রাখা হয়েছে।প্রায় এক শতাব্দী ধরে নিজ ভূমিতে দখলদার ইহুদিদের হাতে তারা মার খেয়েছে। জনপদে শহীদ করেছে প্রায় অর্ধ লক্ষ। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রক্ত ঝরছে। আকাশ ছুঁয়ে গেছে লাশের পাহাড়। এখনো শহীদ হচ্ছে প্রতিদিন। অঝরে কাঁদছে কোটি প্রাণ। একটি ঐতিহাসিকভাবে যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই। ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। আরব মুসলমানরা ছিল জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ। জায়নবাদী মুভম্যান ‘

তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে উসমানীয় সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় ইউরোপীয় শক্তিগুলো তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করে। ব্রিটিশ সরকার একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আরবদের উসমানীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পরিচালিত করেছিল। একটি ইহুদি রাষ্ট্র কীভাবে শিশু, নারী নির্যাতন, হত্যা, ঘুম, ধর্ষণ ও ঐতিহাসিক অমানবিক নির্যাতনসহ ফিলিস্তিনি ভূমি দখলের বাস্তব উদাহরণ, বর্তমান ইসরাইলি ধারাবাহিকতায় এই ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক প্রচেষ্টা স্থানীয় আরব জনগোষ্ঠীর জটিল গতিশীলতা সহ উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, যারা বহু শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলে বাস করেছিল। ইউরোপীয় শক্তি, বিশেষত ব্রিটেনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে, ইসরাইলি সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, খাদ্য ও জ্বালানি সংকট, চিকিৎসার অভাব এবং শিক্ষার সুযোগ কমে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর নীরব সমর্থন এবং জাতিসংঘের সীমিত কার্যকারিতার কারণে ফিলিস্তিনিরা ক্রমাগত নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছে। ইসরাইলি দখলদারিত্বের ফলে বহু ফিলিস্তিনি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যার ফলে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে।যদিও ফিলিস্তিন সংকটের চিত্র বেশ অন্ধকারময়, তথাপি আশার আলো এখনও বিদ্যমান। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলো ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হচ্ছে। এবং তারা কথা বলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ফিলিস্তিন ইস্যুতে সচেতন হচ্ছে এবং আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। মুসলিম বিশ্ব ও অন্যান্য সংবেদনশীল রাষ্ট্রগুলো কূটনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সংগ্রাম,অগ্রগতি ও প্রতিরোধ প্রমাণ করে যে ন্যায়বিচারের আশা কখনও নিভে যায় না। এটি আরো বেগমান হয় বহুমাত্রায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকা, মুসলিম বিশ্ব ও অন্যান্য সংবেদনশীল জাতিগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, এবং ফিলিস্তিনি জনগণের দৃঢ়সংকল্প একদিন এই সংকটের সমাধান আনতে পারে। যুদ্ধ ও নিষ্পেষণের মধ্যেও ফিলিস্তিনের মানুষের আশার প্রদীপ এখনো জ্বলছে।নিরবচ্ছিন্ন দমনপীড়নের মধ্যেও ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। তারা অস্ত্রের চেয়ে বেশি ব্যবহার করছে সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐক্যের শক্তিকে। সাহিত্য, কবিতা ও শিল্পের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা বিশ্ববাসীর কাছে তাদের কষ্ট ও আকাঙ্ক্ষার কথা পৌঁছে দিচ্ছে। মাহমুদ দরবিশের কবিতা, ঘাসান কানাফানির সাহিত্য এবং সাম্প্রতিক আমাদের মত তরুণ লেখকদের কণ্ঠ ফিলিস্তিনের আশার বার্তা বহন করছে। যা কিছুটা হলেও আত্মা প্রফুল্ল হয়।  ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। কিছু দেশ ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে, আবার কিছু দেশ ফিলিস্তিনের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এখনো কার্যকর কোনো সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আসলে তারা চাচ্ছে না এরকম বাস্তবতা মনে হচ্ছে। গত মাসে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি। কারন ইসরাইল এখনো এর আধিপত্য ও জুলুমের সয়লাব নিয়তই কোন না কোন ভাবে ঘটছে।এদিকে হামাস অভিযোগ করেছে যে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, যার ফলে তারা জিম্মি মুক্তি স্থগিত করেছে। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, যা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। ফিলিস্তিনিরা এই প্রস্তাবকে তাদের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন। এবং তারা ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যুদ্ধ, নিষ্পেষণ ও আশার দ্বন্দ্বে ফিলিস্তিন সংকট একটি জ্বলন্ত ইস্যু হিসেবে টিকে আছে। তবে ইতিহাস প্রমাণ করে, অন্যায় ও দখলদারিত্ব চিরস্থায়ী হতে পারে না। ফিলিস্তিনের জনগণ তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে, আর তবে আমি মনে করি এখনই বিশ্ববাসীর উচিত অসহায় ফিলিস্তিনিদের   পাশে দাঁড়ানো ও ন্যায়বিচারের পক্ষে প্রতিবাদী কণ্ঠ তোলা। ফিলিস্তিন সংকটের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ ও নিষ্পেষণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানবিক হস্তক্ষেপ,উদ্যোগ এবং আঞ্চলিক প্রচেষ্টায় কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছে। তবে, স্থায়ী সমাধানের জন্য সকল পক্ষের মধ্যে আন্তরিক সংলাপ ও সমঝোতা অপরিহার্য। ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও প্রতিরোধ প্রমাণ করে যে ন্যায়বিচারের আশা কখনও নিভে যায় না। তবে বাস্তবতা নিরিখে আমরা মনে করি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকা, মুসলিম বিশ্ব ও অন্যান্য সংবেদনশীল জাতিগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, এবং ফিলিস্তিনি জনগণের দৃঢ়সংকল্প একদিন এই সংকটের সমাধান আনতে পারে। যুদ্ধ ও নিষ্পেষণের মধ্যেও ফিলিস্তিনের মানুষের আশার প্রদীপ এখনো জ্বলছে। ফিলিস্তিনিরা এখনো হৃদয় স্বপ্ন আঁকছে যে,তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের লীলাভূমি এই পবিত্র মুকাদ্দাসে তাদের হারানো ঐশ্বরিক হাসি ফুটবে এবং আলোকিত করবে পৃথিবীবাসীকে। 

নিউজটি শেয়ার করুন