হৃদয়ে আমার ইকবাল – সালিমা মেহরা

হৃদয়ে আমার ইকবাল

আমার বিনয় শিক্ষার প্রথম অধ্যায়ে শুনেছিলাম,
এ মহাবিশ্ব আর সৃষ্টি রহস্যের মহাসাগরে আমি এক জলকণা মাত্র।
আর আপনি সে জলকণার হৃদয়ে প্রশস্ততার বীজ বুনে দিলেন।
বললেন:
তুমি সেই জলকণা যার ভেতরে রয়েছে গোটা সমুদ্র,
দেখালেন ‘ইনসানে কামিল’ হবার দর্শন।
বললেন:
তুমি মুসলিম,
মনকে এই জগতের সাথে বেঁধে রেখো না,
অর্বাচীন প্রশ্নসমূহের আবর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলো না।
মুসলিম কভূ ভূ-সীমার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না।

বর্তমান সময়ে মনুষ্য হৃদয় বড় ফেলনা,
আদনা বলে নিলামে কেউ দাম হাঁকে না।
তবে সে হৃদয় কে সম্বোধন করেই আপনার ‘খুদি’ দর্শন।
বুলন্দ খুদি দর্শনের পথ ধরে আপনার লেখা ‘আসরারে খুদি’র সাথে আমার প্রথম মানসিক মোলাকাত।
আপনার কাব্য দর্শনের মহল্লায় প্রবেশ করে দেখতে পেলাম;
আল্লাহর অস্তিত্বের ছায়ায়,
অনন্ত জীবন বেঁচে থাকার জন্য,
মুসলিম গোত্রের খুদি(ব্যক্তিত্ব/আত্নমর্যাদাবোধ) কে প্রয়োজন।
খুদিতে নিমজ্জিত সত্তা করে আত্নবিশ্লেষণ আত্নগবেষনা।
তবে তাঁর এ আত্ননিমগ্নতা
আত্মোপলব্ধি আর আত্নশক্তির লালনই হলো জাতির উত্তরণে
ব্যক্তিত্বের পরম বিকাশ।

যার মাধ্যমে পূর্ণ মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করা যায়।
খুদি হলো ঈমানমুখী সেই আত্মসত্তা যে আল্লাহর গুণাবলি আত্মস্থ করে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ছায়ায়।
খুদি দর্শন আত্ননিমগ্ন তবে অকর্মণ্য নয় বরং
ইচ্ছাশক্তির সৃজনশীল প্রকাশ যা কর্মে প্রতিফলিত হয়।
সোজা কথায় খুদি হলো অত্যুচ্চ ব্যক্তিত্ববাদের সেই দর্শন যেখানে মানুষ এক অপরিমেয় অভাবনীয় শক্তির আধিকারী।
প্রবৃত্তিতাড়িত নফসের কারাগারের বাইরে এসে আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য নিয়ে জয় করে সকল তুচ্ছতা ক্ষুদ্রতা ও ভয়।
সত্য কে বুকে ধারণ করে সর্বজয়ী শৌর্য আর গরিমার উদ্ভাব ঘটায়। আর এরই মধ্য দিয়ে ব্যক্তি হয়ে ওঠে আল্লাহর প্রতিনিধি (খলিফা)।
খুদির বিকাশ ঘটে প্রথমত আনুগত্যের ধারায়।সে তার রবের আনুগত্যে মহীয়ান হয় তার স্বাধীন কর্মচঞ্চল সৃজনশীলতার সীমানা খুঁজে পায়।
আপনার ভাষায়:
‘তকদীরের আনুগত
উদ্ভিদ জড়পিন্ড যত,
মুমিন অনুগত শুধু খোদার নির্দেশের।’
আনুগত্যের পর আত্ননিয়ন্ত্রণ আনে খুদির উৎকর্ষ।

আপনি কি অবলীলায় উচ্চারিছেন:
“পৃথিবীর পরিধিতে হারিয়ে যায় কাফেরের পরিচয়
মুমিনের বক্ষে এ পৃথিবী বেমালুম গুম হয়ে যায় ।”
আনুগত্য আর আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ পাড়ি দিয়ে খুদির বিকাশ তার পরম কাঙ্খিত ধাপে পৌছায়।
আল্লাহর নৈকট্য বা সান্নিধ্য।
‘খুদি’ বিকাশের এই চূড়ান্ত ধাপ পেরিয়ে বহমান কর্মপ্রবণ।
আপনার দৃষ্টিতে:
আমল সে জিন্দেগি বনতি হে, জান্নাত ভি, জাহান্নাম ভি।’
কর্ম দিয়েই জীবন গড়ে-
জান্নাতও কর্মফল, নরকও কর্মফল।
আর এই কর্ম দুনিয়ায় মুমিনকে দেয় সেই শক্তি যা আপনার ভাষায়:
‘খুদির যদি আত্নদৃষ্টি থাকে
আত্নসজ্জা আর আত্মপ্রতিষ্ঠার শক্তি
তাহলে মৃত্যুর নিষ্ঠুর আঘাতে
মৃত্যু তোমার নাও হতে পারে।’

খুদি বুলন্দ ব্যক্তিত্বে মৃত্যু নেই:
‘মৃত্যুর ফেরেশতা যদিও স্পর্শ করে শরীর তোমার
তোমার অস্তিত্বের কেন্দ্র থেকে বহুদূরে অবস্থান তার।’
‘অশান্ত আঁখি আর আশান্বিত অন্তর নিয়ে
আমি চাই পরিসমাপ্তি তারই
যা সমাপ্তিহীন।’
এ জীবনমুখী দর্শনে
পতিত জাতির সানাইয়ের ধরিয়ে ছিলেন আগুন যাতে মূসাদের আবির্ভাব সম্ভব হয়।
দার্শনিকের অভিপ্রায়ে সাধারণত থাকে
সকলকে ফুলের চাষে ব্রতী করা,
তবে সেখানে কীটের বিনাশের আলাপ থাকে না।তবে আপনি ছিলেন স্বতন্ত্র । দার্শনিকের
দর্শনের কল্পরাজ্য থেকে বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
ফুল চাষের পাশাপাশি তুলেছেন কিটের বিনাশের আলাপ।
আপনি শব্দের সৌন্দর্যে আটকে থাকা কোন কবি নন।
পতিত জাতির উত্তরণে তাদের কর্নকুহরে বলেছেন,কল্পনার সাম্রাজ্যের চেয়ে বাস্তবতার একটু উঠান অধিক কার্যকর।
তাই আপনার হৃদয়ে দেখেছি আল্লামা জালালউদ্দিন রুমি তবে উচ্চারণে আর কর্মে আরও ন্যায়শাস্ত্রানুগ ছিলেন আপনি।
নীটশের পাশ্চাত্যের দর্শন কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কি অসীম নিষ্ঠায় বলেছেন-
তাওহীদ তত্ত্ব জ্ঞানী হতে পারেনি দার্শনিক
লা-ইলাহা তত্ত্বের জন্য প্রয়োজন অন্তর্দৃষ্টির।

এ দর্শনের অলিন্দে আপনার ধর্মের ব্যাখ্যা অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার পদ্ধতি।
তাই
স্বপ্ন বিভোর মন আমার কিসওয়ার ছায়া থেকে ছুটে যায় লাহোর,যেন আমি দাড়িয়ে এক মর্দে মুমিনের শেষ আবাসের সামনে আর হৃদয়ে গুনগুন বলছি-
খুদি কো কর বুলান্দ ইতনা কে হার তাকদির সে পহলে/খুদা বন্দে সে খুদ পুঁছে, বাতা তেরি রেজা কিয়া হে।