বরফযুগের নীল বাইসন ‘ব্লু বেব’: ৫০,০০০ বছরের পুরনো মাংসের গল্প

বরফযুগের নীল বাইসন ‘ব্লু বেব’: ৫০,০০০ বছরের পুরনো মাংসের গল্প

১৯৭৯ সালের এক গ্রীষ্মে আলাস্কার ফেয়ারব্যাঙ্কসের কাছে একটি সোনার খনিতে কাজ করছিলেন খনি শ্রমিক ওয়াল্টার রোমান ও তাঁর স্ত্রী রুথ রোমান। হঠাৎ হাইড্রলিক হোস দিয়ে বরফ ও মাটি গলাতে গলাতে তাঁরা দেখতে পেলেন এক অদ্ভুত জিনিস একটি বিশাল প্রাণীর হাড় এবং গলার অংশ মাটির নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে। তাঁরা দ্রুত বুঝতে পারলেন, এটি কোনো সাধারণ প্রাণী নয়। খবর পৌঁছে যায় ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কার বিজ্ঞানীদের কাছে।

বিজ্ঞানী ড. ডেল গাথরি ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিশ্চিত করলেন, এটি বরফযুগের একটি বাইসনের (Bison priscus) মৃতদেহ অন্তত কয়েক দশ হাজার বছর পুরনো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন, এটিকে যত দ্রুত সম্ভব উদ্ধার করতে হবে, নইলে গলতে শুরু করলে পুরোটা নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু সহজ ছিল না কাজটা। জমাটবাঁধা বরফের মাটিতে, বিশাল বরফের খণ্ডের পাশে আটকে ছিল সেই বাইসনের দেহ। প্রতিদিন গরমে সামান্য কিছু মাটি গললেও বাইসনটি পুরোপুরি জমে ছিল।

শেষে কেবল মাথা ও গলার অংশ বরফে আটকানো অবস্থায় দেহটি ঝুলতে থাকে মাটির দেয়াল থেকে। আশঙ্কা হচ্ছিল, গলতে থাকা অংশ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই ড. গাথরি সিদ্ধান্ত নেন দেহটিকে মাথা থেকে আলাদা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়ে পুনরায় জমিয়ে রাখতে হবে। পরবর্তী সময়ে মাথা ও গলার অংশও সাবধানে খনন করে উদ্ধার করা হয়।

খননের সময় আশেপাশের গলে যাওয়া মাটি ও বরফ ধুয়ে ধুয়ে আলাদা করা হয় হাড়ের টুকরো, পশম, কীটপতঙ্গ, কাঠ ও গাছের অবশেষ। এসবের প্রতিটি নমুনা ও প্রাণীর দেহের অবস্থান নিখুঁতভাবে রেকর্ড করা হয়। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা পুনর্গঠন করতে পারেন বাইসনের মৃত্যুর কাহিনি।

নীল রঙের রহস্য কি?

যখন বাইসনটিকে আবিষ্কার করা হয়, তখন পুরো দেহে ছিল এক ধরনের নীলচে খনিজের আস্তরণ। পরে জানা যায়, সেটি আসলে “ভিভিয়ানাইট” (Vivianite)—একটি সাদা খনিজ পদার্থ, যা প্রাণীর টিস্যুর ফসফরাস মাটির লোহা (Iron)-এর সঙ্গে বিক্রিয়া করে তৈরি হয়। বাতাসে এক্সপোজার হওয়ার পর সেটি নীল হয়ে যায়। এই নীলচে রঙের কারণেই বিজ্ঞানীরা স্নেহভরে এর নাম দেন “ব্লু বেব”, কিংবদন্তির বিশাল নীল ষাঁড় “Paul Bunyan’s Blue Ox”-এর অনুপ্রেরণায়।

তৎকালীন কার্বন ডেটিং পরীক্ষায় দেখা যায়, বাইসনটি মারা গিয়েছিল প্রায় ৩৬,০০০ বছর আগে। তবে নতুন গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কিউরেটর জশ রেউথার (Josh Reuther) বলেন, এর বয়স অন্তত ৫০,০০০ বছর। আধুনিক রেডিওকার্বন ডেটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই নতুন বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। তার দেহের পিছনের অংশে থাবার দাগ ও দাঁতের গর্ত পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে এটি সম্ভবত বরফযুগের আমেরিকান সিংহ (Panthera leo atrox)-এর হাতে নিহত হয়েছিল যা আধুনিক আফ্রিকান সিংহের পূর্বপুরুষ।

কিভাবে মৃত্যু হলো?

সেই ভয়ংকর সিংহ বাইসনের দেহের একপাশ চিরে খুলে দেয়, পাঁজর ও কাঁধের অংশ থেকে মাংস টেনে খায়। পরে নেকড়ে, শিয়াল, উলভারিন এমনকি কাকের মতো প্রাণীরা বাকি অংশে ভোজ দেয়। মৃত্যুর সময় বাইসনের শরীরে ঘন পশম ও চর্বির স্তর পাওয়া যায়, যা দেখায় যে প্রাণীটি সম্ভবত শরতের শেষ বা শীতের শুরুতে মারা যায় যখন ঠাণ্ডা ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছিল। ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় দেহটি দ্রুত জমে যায়, ফলে বাকি শিকারিরা আর বেশি কিছু করতে পারেনি।

সম্ভবত প্রাণীটি উপত্যকার তলায় মারা গিয়েছিল, অথবা বরফ ও কাদা গলে নেমে আসা স্রোতে সেখানে চলে আসে। এরপর আশপাশের পাহাড় থেকে মাটি ও সিল্ট ধুয়ে এসে ধীরে ধীরে সেটিকে ঢেকে ফেলে। গ্রীষ্মে উপরিভাগে উষ্ণতা থাকলেও নিচের ঠাণ্ডা মাটি পচন রোধ করে রাখে। শীত এলে আবার সেই দেহ জমে যায় বরফে, আর ধীরে ধীরে এটি পেরমাফ্রস্ট স্তরের অংশ হয়ে ওঠে যেখানে হাজার বছর ধরে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

কিভাবে সংরক্ষণ হলো?

Eirik Granqvist ব্লু বেবের ট্যাক্সিডার্মি (চামড়া সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের প্রস্তুতি) নিয়ে কাজ করছেন। — আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ মিউজিয়াম

“ব্লু বেব”-এর সংরক্ষণ এতটাই অসাধারণ ছিল যে বিজ্ঞানীরা তার চামড়ার মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধা অবস্থায় পেয়েছিলেন—সেই জায়গাগুলোতেই সিংহের দাঁত ও নখের দাগ ছিল। কিছু মাংস শুকনো গরুর মাংসের মতো শক্ত ও লালচে ছিল, হাড়ের ভেতরে এখনও সাদা মেদ জমে ছিল। চামড়ার নিচে চর্বির স্তর রয়ে গিয়েছিল, যদিও পশম কিছুটা পচে গিয়েছিল। এমনকি চারটি পায়ের খুর অক্ষত অবস্থায় ছিল, ঠিক যেমনভাবে সেটি মৃত্যুর সময় ছিল। মাথার শিংগুলোও খুলে যায়নি যা সাধারণত প্রাণী মৃত্যুর পর দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

উন্মোচিত হলো একটি যুগের জানালা

বরফযুগের এমন সংরক্ষিত প্রাণী পৃথিবীতে অতি বিরল। সাইবেরিয়া ও আলাস্কার স্থায়ী বরফের নিচে পাওয়া গেছে মাত্র হাতে গোনা কিছু উদাহরণ। “ব্লু বেব” সেই তালিকায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ। এত বছর পরেও এর মাংস, হাড় ও কোষের অবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত ছিল—যেন সময় সেখানে থেমে গেছে।

এমনভাবে সংরক্ষিত প্রাণীর সংখ্যা এত কম যে, “ব্লু বেব”-এর মতো সম্পূর্ণ পুনর্গঠন ও প্রদর্শনের সুযোগ বিশ্বের মাত্র তিনটি ক্ষেত্রে ঘটেছে। দু’টি রাশিয়ার লেনিনগ্রাদে (বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ) উলি ম্যামথ প্রদর্শনী, আর তৃতীয়টি এই ব্লু বেব, যা আজও প্রদর্শিত হচ্ছে University of Alaska Museum-এ।

বাইসনের রান্না মাংস

গবেষণার কাজ শেষ হলে, ১৯৮৪ সালে ড. গাথরি ও তাঁর দল সিদ্ধান্ত নেন এই ইতিহাসের অংশটিকে অদ্ভুতভাবে উদযাপন করবেন। তারা বাইসনের গলার কিছু মাংস কেটে সবজি ও মশলা দিয়ে রান্না করেন ৫০,০০০ বছরের পুরনো এক স্ট্যু! ‘আইস এজ স্ট্যু’-তে চামচ ডুবিয়ে তাঁরা আস্বাদন করেন প্রাগৈতিহাসিক এক যুগের গন্ধ। পরে ড. গাথরি মজা করে বলেছিলেন, “মাংসটা একটু শক্ত হলেও এক ধরনের ‘প্লেইস্টোসিন’ গন্ধ ছিল, যা ভোলার নয়।” আশ্চর্যের বিষয় খাওয়ার পর কেউই অসুস্থ হননি।

“ব্লু বেব” শুধু একটি মৃত প্রাণী নয়, বরং এক অমূল্য বার্তাবাহক যে আমাদের জানিয়ে দেয়, প্রকৃতি কীভাবে সময়ের অতল গহ্বরেও জীবনের ছাপ অমলিন রাখে। বরফযুগের নীরবতার ভেতর থেকে উঠে আসা এই নীল বাইসন আজও সাক্ষ্য দেয় পৃথিবীর অতীতের বিস্ময়কর ইতিহাসের। হয়তো একদিন, বরফের নিচে ঘুমিয়ে থাকা আরও কত রহস্যই এমনভাবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে সময়ের সীমানা পেরিয়ে, এক অমর “দূত” হয়ে।

সূত্র:

University of Alaska Museum Archives (Gary Selinger, UA Magazine, June 1986)

The Dinner Party That Served Up 50,000-Year-Old Bison Stew, atlasobscura, August 21, 2019