
ইসলামো-ফিলিয়া
হুমাইয়া ছালছাবিল ফাইজা
[তিন]
ভিনসেন্ট ভ্যানগগের নৈসর্গিক আলোকপাতে আঁকা পোট্রেট মৃণালের পড়ার ঘরে। এ ঘরেই আড্ডার আসরে গানের বিশদ চর্চা করা হয়। শিল্পী মানুষদের চেহারার রূপরেখায় খুব চেনা দুঃখ লুকিয়ে থাকে, এমন দুঃখ যা চিনতে পারলেও মুখে প্রকাশ করা যায় না। মুখে বলতে গেলেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়। তাই অস্বস্তি থেকে নিজেকে বাঁচাতে চুপচাপ ভ্যানগগের পোট্রেটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নোমান।
সন্ধ্যায় রিহার্সেলে এসেছে গানের দলের সবাই, ফরিদ দুনিয়াভোলা মনোযোগ দিয়ে নোমানের গিটারের তার ঠিক করছে। আনিকা, প্রমী গানের লিরিক্স সম্পর্কিত আলাপে ব্যস্ত। মৃণাল খোলা গলায় ভাটিয়ালি সুর তুলছে, রিসাদ সিনথেসাইজারে তাল মেলাচ্ছে আবেগে আপ্লুত হয়ে। পল্লীগীতির প্রত্যেক জনরার প্রতি রিসাদের আলাদা একটা ভালোবাসা রয়েছে, তার বেশভূষা দেখেও অনুমান করা সম্ভব যে সে একজন পল্লীপ্রেমী খাঁটি বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী মানুষ, যাকে বলে একেবারে পুরোদস্তুর মাছে-ভাতে বাঙালি।
—এই ছবিটা তোকে কে দিয়েছে রে মৃণাল..?
অপরিচিতের মতো করে নোমান জিজ্ঞেস করল।
—কেউ দেয়নি রে, আমিই কিনেছি। ভ্যানগগের মুখটা দেখলে আমি যেকোনো কাজে সাহস পাই।
—কীভাবে সাহস পাস?
—তুই জানিস ভ্যানগগ নিজের চেহারা নিয়ে সারাজীবন হীনমন্যতায় ভুগেছিলেন, আমি নিজেকে ওনার মধ্যে দেখতে পাই। উনি যদি অমন হীনমন্যতা নিয়ে ‘স্ট্যারি নাইটের’ মতো ছবি এঁকে বিশ্ব জয় করতে পারেন, তাহলে আমিও একদিন বিশ্ব জয় করতে পারব। এই সাহস নিয়েই তো বেঁচে আছি রে!
সাহসের কথায় আনিকা লিরিক্সের আলাপ বাদ দিয়ে মৃণালের কথার সাথে তার সাহস জাগানিয়া ছবির কাহিনী জুড়ে দিলো। সেও নাকি শোবার ঘরে মেরিলিন মনরোর জলরঙে আঁকা পোট্রেট রেখে দিয়েছে। প্রতিদিন সেই পোট্রেটকে সকাল-সন্ধ্যা অবলোকন করলে নাকি তার দিন ভালো যায়।
খিলখিল করে হাসছে রিসাদ আর বলছে সে সাদামাটা মানুষ আকাশের চাঁদ দেখলেই তার রাতে ঘুম দিব্যি হয়; সকালের প্রথম রোদ গায়ে মাখলেই দিনটা চাঙ্গা যায়। ফরিদ গিটারের তার ঠিক করতে করতে বলছে মন খারাপ থাকলে সে রক মিউজিক লাউড স্পিকারে শুনতে থাকে, এতেই মন ভালো হয়ে যায়।
মেটাল বিট ডিএনএ-তে খুব সূক্ষ্ম একটা জ্যামিতিক পথ দেখিয়ে দেয়, সে পথ ধরে সে হাঁটে ফুলের সারির মধ্যখানে। এছাড়া আলাদা করে আর কিছুর প্রয়োজন হয় না। নোমান ভ্যানগগের চিত্রের দিকে তাকিয়ে বলছে, সেও গিটারে প্রিয় গান না তুললে সারা দিনটা মনমরা হয়ে থাকতে হয়। এ কথার সাথে নোমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে থাকে, কোনো জীব বা জড়বস্তুর মুখাপেক্ষী হওয়া একধরনের দুর্বলতা; এ দুর্বলতায় বেঁচে থাকা বিষাদের।
হালকা তালে বাজতে থাকা সিনথেসাইজার থেমে যায় রিসাদের, নোমানের কথাটা যেন মনের মাঝ বরাবর বিঁধলো। মৃণাল শিল্পীর চেহারায় কেমন করে শিল্প লুকিয়ে থাকা তা নিয়ে ভাষণ দিতে শুরু করল এরপর। চুপ করে রইলো শুধু প্রমী, আজ সকালে নোমানের ব্যবহার মনের গহীন আঘাতে করেছে তাকে; ভীড় থেকে যখন বের হয় নোমান, প্রমীর সাথে চোখাচোখি হয়েছিল একটু দূর থেকে। অথচ না দেখার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে চলে গিয়েছিল ছেলেটা। পরে প্রমী অশ্রু আশ্রিত নয়নে রিকশা ডেকে বাসায় ফিরেছিল একা, যদিও আজ বড় সাধ হচ্ছিল তার নোমানের সঙ্গে রিকশায় ঘুরে টিএসসি চত্বরে গিয়ে ফুচকা খাওয়ার। কিন্তু সে আর হলো কই। তার চেহারায় কুয়াশা নেমেছে, অভিমানের কুয়াশা।
—আচ্ছা তোদের কারোর ঘরে কুরআন শরীফ নেই?
নোমান আবারো প্রশ্নটা করল।
বিরক্ত ভরে মৃণাল বলল,
—সেই সকাল থেকে এই প্রশ্নটা করে চলেছিস, কি হয়েছে রে তোর?
রিসাদ বাঁকা হেসে বলে ওঠে,
—আমরা গানের মানুষ, ওসব ধর্মকর্ম করে কী আর হবে বল..।
ফরিদ বিষয় বদলের তাগিদ দেখিয়ে সতর্ক করছে সামনেই ঈদ, তাই এসব কথা না বাড়িয়ে গানে মনে দেয়া উচিত। আনিকা মৌন সম্মতি জানিয়ে গানের বিষয়বস্তু কেমন হবে তা জিজ্ঞেস করছে নোমানকে।
এককোণে নিশ্চুপে বিরহ বীজ রোপণ করছে প্রমী, গানের খাতা ফাঁকা পড়ে আছে। বর্তুলাকার সোফার পাশের ঝুড়িতে পড়ে আছে ভুল কথায় লেখা গানের অনেকগুলো কাগজ, যেসবের কোনো মানেই নেই।
সকালে বলেছিল সে সপ্তাহে একদিন করে কুরআন পড়ে, আসলে তা নয়। সে আজ প্রায় তেরো বছর ধরে কুরআন খুলেও দেখেনি। নোমানের মৃণালের বাসায় কুরআন আছে কিনা জানতে চাওয়ার ভঙ্গিমায় একটা অদ্ভুত উচ্ছ্বাস গোপন ছিল; প্রমী শুধু চেয়েছিল নোমানের সেই উচ্ছ্বাসকে ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু শেষমেশ ছুঁতে না পারার দুঃখ নদীতে ভাসতে হচ্ছে তাকে।
চলবে…