নসীম হিজাযী: ইতিহাসের ধুলোপড়া পাতায় প্রাণের স্পন্দন জাগানো এক জাদুকর

ইতিহাসের নির্মম সত্য আর সাহিত্যের রোমান্টিকতাকে এক সুতোয় গেঁথে যিনি দক্ষিণ এশিয়ার লক্ষ লক্ষ পাঠকের হৃদয়ে নিজের স্থান পাকা করে নিয়েছেন, তিনি নসীম হিজাযী। তার প্রকৃত নাম শরীফ উল হক, কিন্তু সাহিত্যজগতে তিনি নসীম হিজাযী নামেই অমর হয়ে আছেন। সাধারণ পাঠকের কাছে ইতিহাস মানেই যেখানে সাল, তারিখ আর যুদ্ধের নীরস বিবরণ, সেখানে নসীম হিজাযী ইতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন তা চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কোনো জীবন্ত চলচ্চিত্র। তিনি কেবল একজন ঔপন্যাসিক ছিলেন না; ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, চিন্তাবিদ এবং একটি বিশেষ মতাদর্শের জাগরণকারী। নিচে তার জীবন, কর্ম ও সাহিত্যিক প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

নসীম হিজাযীর জন্ম ১৯১৪ সালে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাসপুর জেলায়। ব্রিটিশ শাসনামলের সেই উত্তাল সময়ে বেড়ে ওঠার কারণে তার মনোজগতে পরাধীনতার গ্লানি এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রবলভাবে গেঁথে গিয়েছিল। তিনি তার শিক্ষা ও কর্মজীবনের বড় একটি অংশ সাংবাদিকতায় ব্যয় করেন। তিনি ‘দৈনিক কোহিস্থান’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং সাংবাদিক হিসেবেও বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তবে সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি অনুভব করেছিলেন যে, কেবল সংবাদ দিয়ে জাতির ঘুমন্ত বিবেককে জাগানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন এমন এক সাহিত্যিক মাধ্যম, যা মানুষকে তার শেকড়ের সন্ধান দেবে। এই ভাবনা থেকেই তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার দিকে ঝুঁকে পড়েন।

সাহিত্যের মূল দর্শন ও উদ্দেশ্য

নসীম হিজাযীর সাহিত্যের মূল উপজীব্য ছিল ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল অতীত এবং মুসলিম উম্মাহর ট্র্যাজিক পতন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি জাতি যদি তার ইতিহাস ভুলে যায়, তবে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আল্লামা ইকবালের দর্শনে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ইকবালের ‘শাহীন’ (ঈগল) বা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন যুবকের ধারণাটি হিজাযী তার উপন্যাসের চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন।

তার লেখার একটি বিশেষ প্যাটার্ন বা ছক ছিল। তিনি দেখাতেন, বাইরের শত্রুর চেয়ে ঘরের শত্রুরা (বিশ্বাসঘাতকরা) জাতির জন্য বেশি বিপজ্জনক। স্পেনের পতন হোক কিংবা বাগদাদ বা মহীশূরের পতন সর্বত্রই তিনি মীরজাফরদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল পাঠকদের মনে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, ঐক্য, ঈমান এবং দেশপ্রেম থাকলে ক্ষুদ্র শক্তি দিয়েও বৃহৎ শক্তিকে পরাজিত করা সম্ভব।

৩. কালজয়ী সৃষ্টিসমূহ: ইতিহাসের আয়না

নসীম হিজাযীর প্রতিটি উপন্যাসই একেকটি মহাকাব্যিক ক্যানভাস। তার বিখ্যাত কিছু কর্মের বিস্তারিত আলোচনা নিচে দেওয়া হলো:

ক. শাহীন (স্পেনের কান্না):

নসীম হিজাযীর সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং পঠিত উপন্যাস হলো ‘শাহীন’। স্পেনের গ্রানাডার পতন নিয়ে রচিত এই উপন্যাসে তিনি মুসলিম স্পেনের শেষ দিনগুলোর এক হাহাকারময় চিত্র এঁকেছেন। বদর বিন মুগিরা এবং তার সঙ্গীদের গেরিলা যুদ্ধ, গ্রানাডার শাসকবর্গের বিলাসিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা এবং শেষ পর্যন্ত স্পেনের মাটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ হওয়ার করুণ কাহিনী পাঠকদের আজও কাঁদায়। এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, বিলাসিতা আর অনৈক্য কীভাবে একটি শক্তিশালী সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

খ. আখেরি চাটান (শেষ প্রান্তর):

চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে তাতারীদের (মোঙ্গল) বিশ্বগ্রাসী আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাস। এখানে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সুলতান জালালুদ্দিন খিবারকে (খওয়ারিজম শাহ)। যখন একে একে মুসলিম সালতানাতগুলো তাতারীদের পায়ের নিচে পিষ্ট হচ্ছিল, তখন একজন মানুষ কীভাবে পাহাড়ের মতো অটল দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, তা তিনি দেখিয়েছেন। মধ্য এশিয়ার সমরকন্দ ও বুখারার পতন এবং সিন্ধু নদের তীরে জালালুদ্দিনের শেষ লড়াইয়ের বর্ণনা এতটাই জীবন্ত যে, পাঠক শিহরিত হতে বাধ্য হন।

গ. খাক আর খুন (রক্ত ও ধূলিকণা):

এটি তার অন্যান্য ঐতিহাসিক উপন্যাস থেকে কিছুটা ভিন্ন। কারণ, এটি সুদূর অতীতের কোনো ঘটনা নয়, বরং ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত। ভারত বিভক্তির সময় পাঞ্জাবের মুসলমানদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন, হত্যা ও লুটতরাজ চলেছিল, তার এক দগদগে ঘা এই উপন্যাস। নিজের চোখের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে লেখা এই উপন্যাসে বাস্তুচ্যুত মানুষের হাহাকার এবং নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মের বেদনা ও আনন্দ উভয়ই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।

ঘ. ইউসুফ বিন তাসফিন ও কায়সার ও কিসরা:

‘ইউসুফ বিন তাসফিন’ উপন্যাসে তিনি স্পেনের আল-মুরাবিতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতার বীরত্ব তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে ‘কায়সার ও কিসরা’ উপন্যাসে ইসলামের প্রাথমিক যুগে রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন এবং ইসলামের উত্থানের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও ‘মুহাম্মদ বিন কাসিম’ উপন্যাসে সিন্ধু বিজয়ের রোমাঞ্চকর অভিযান তিনি বর্ণনা করেছেন।

৪. চরিত্র চিত্রণ ও লেখার শৈলী

নসীম হিজাযীর লেখার ধরন অত্যন্ত আবেগঘন। তার উপন্যাসের নায়করা সাধারণত অত্যন্ত সুদর্শন, ধার্মিক, অকুতোভয় এবং নীতিবান হন। অন্যদিকে নায়িকারা হন লজ্জাবতী, ত্যাগের মূর্ত প্রতীক এবং প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে নিতেও পিছপা হন না।

তার উপন্যাসে ভিলেন বা খলনায়কদের চরিত্র চিত্রণও অত্যন্ত শক্তিশালী। তিনি বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা তৈরি করতে পারতেন। তার বর্ণনার ভঙ্গি বা ‘ন্যারেটিভ স্টাইল’ এতটাই শক্তিশালী যে, পাঠক পড়তে পড়তে নিজেকে সেই যুদ্ধক্ষেত্রে বা রাজপ্রাসাদে কল্পনা করতে শুরু করেন। তিনি যুদ্ধের বর্ণনায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন তলোয়ারের ঝনঝনানি আর ঘোড়ার খুরের শব্দ তার শব্দচয়নে মূর্ত হয়ে উঠত।

বাংলা সাহিত্যে ও বাংলাদেশে নসীম হিজাযী

উর্দু ভাষার লেখক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে নসীম হিজাযী অবিশ্বাস্য রকমের জনপ্রিয়। গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার বইগুলোর বাংলা অনুবাদ দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। মল্লিক ব্রাদার্স, আধুনিক প্রকাশনীসহ বিভিন্ন প্রকাশনী তার প্রায় সব বই অনুবাদ করেছে।

বাংলাদেশের কিশোর ও তরুণ পাঠকদের মধ্যে নসীম হিজাযীর বই পড়ার একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। বিশেষ করে যারা ইসলামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী, তাদের পাঠ্যতালিকায় হিজাযী অপরিহার্য। তার ‘শাহীন’ বইটি পড়ে অনুপ্রাণিত হননি, এমন পাঠক বাংলাদেশে বিরল। ভাষাগত ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও অনুবাদের মাধ্যমে তিনি বাঙালি পাঠকের ঘরের মানুষে পরিণত হয়েছেন।

একটি যুগের অবসান

১৯৯৬ সালের ২রা মার্চ এই মহান কথাশিল্পী মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু রেখে যান এক বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার। নসীম হিজাযী কেবল বিনোদনের জন্য লেখেননি, তিনি লিখেছিলেন একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন তার কলমের কালিতে বিস্মৃতপ্রায় এক জাতির ধমনীতে উষ্ণ রক্ত সঞ্চালিত করতে।

আজকের আধুনিক যুগেও যখন কেউ স্পেনের ইতিহাস জানতে চায়, কিংবা তাতারীদের ধ্বংসলীলার চিত্র দেখতে চায়, তাকে নসীম হিজাযীর শরণাপন্ন হতে হয়। তিনি ইতিহাসের কঙ্কালে রক্ত-মাংস জড়িয়ে তাকে জীবন্ত করে গেছেন। যতদিন বাংলা ও উর্দু সাহিত্য টিকে থাকবে, ততদিন ঐতিহাসিক উপন্যাসের রাজপুত্র হিসেবে নসীম হিজাযীর নাম সগৌরবে উচ্চারিত হবে। তার লেখাগুলো কেবল বইয়ের তাকে সাজিয়ে রাখার বস্তু নয়, বরং প্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস।