সুদান: রক্ত, স্বর্ণ আর এক নীরব বিশ্বের গল্প

সুদান: রক্ত, স্বর্ণ আর এক নীরব বিশ্বের গল্প

সুদান – আফ্রিকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশাল এক ভূখণ্ড, নীলনদের উর্বর তীরে গড়ে ওঠা এক সময়ের সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। কিন্তু আজ সেই দেশটি রক্ত, ধ্বংস আর ক্ষুধার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদানের সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)-এর মধ্যে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে পূর্ণমাত্রার গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে দেড় লক্ষাধিক মানুষ, আর বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় এক কোটি বিশ লক্ষ নাগরিক। পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্ভিক্ষ, রোগ ও মানবিক বিপর্যয়। জাতিসংঘের তথ্যে এটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটগুলোর একটি।

যুদ্ধের সূচনা ও কারণ

এই ভয়াবহ সংঘাতের সূত্রপাত আসলে ২০১৯ সালে। তিন দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের পতনের পর সেনাবাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে নতুন দ্বন্দ্বের জন্ম হয়। প্রথমদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং আরএসএফ প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো মিত্র ছিলেন। তারা একসাথে বশির সরকারের পতন ঘটান এবং ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু অচিরেই ক্ষমতার ভাগাভাগি, সেনা কাঠামোর নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা নিয়ে তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে আরএসএফের প্রায় এক লাখ সদস্যকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করা হবে কিনা এই প্রশ্নেই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।

২০২৩ সালের এপ্রিলে আরএসএফ বাহিনী রাজধানী খার্তুমসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান নিতে শুরু করলে সেনাবাহিনী সেটিকে ‘অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা’ হিসেবে বিবেচনা করে। ১৫ এপ্রিল থেকেই শুরু হয় পূর্ণাঙ্গ সংঘর্ষ। দ্রুতই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে দারফুর, গেজিরা, ওমদুরমান, এল-ফাশার পর্যন্ত।

দারফুর ও গণহত্যার অভিযোগ

সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা দেখা গেছে পশ্চিম দারফুরে। সেখানে আরএসএফ ও তাদের সহযোগী মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ ও জাতিগত নিধনের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় ম্যাসালিত জনগোষ্ঠীর হাজারো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, নারীদের ওপর চালানো হয়েছে যৌন নির্যাতন। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে, এসব হামলা অনেকাংশে পরিকল্পিত, যা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, যুদ্ধ চলাকালীন সময় শিশুরাও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে, এমনকি কিছু শিশুকেও জোরপূর্বক সৈন্য বানানো হয়েছে।

সুদানের আল-ফাশেরে গণহত্যা অব্যাহত, প্রমাণ নতুন স্যাটেলাইট চিত্রে

এখন এল-ফাশার ও আশপাশের অঞ্চলে অবস্থানরত প্রায় আড়াই লাখ মানুষের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে। তাদের একটি বড় অংশ নন-আরব জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই সহিংসতা অব্যাহত থাকে, তবে এটি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যায় রূপ নিতে পারে।

আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকা ও স্বার্থ

এই যুদ্ধ এখন শুধু সুদানের অভ্যন্তরীণ সংকট নয়; এটি আন্তর্জাতিক স্বার্থসংঘাতেরও মঞ্চে পরিণত হয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা আরএসএফ বাহিনীকে অর্থ, অস্ত্র ও সরঞ্জাম সহায়তা দিচ্ছে। তাদের মূল লক্ষ্য সুদানের স্বর্ণখনি এবং রেড সাগরের উপকূলে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব বৃদ্ধি করা। বেশ কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুদানের পশ্চিমাঞ্চলের স্বর্ণ খনিগুলো থেকে সংগৃহীত স্বর্ণ আরব আমিরাত হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করছে। যদিও আরব আমিরাত সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে, তবে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘের বিশেষ তদন্তে তাদের সম্পৃক্ততার আভাস পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে, মিশর সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ মিত্র। নীলনদের পানিবণ্টন ও সীমান্ত নিরাপত্তা মিশরের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা সুদানের সরকারি বাহিনীকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে সহায়তা করছে। রাশিয়াও পরোক্ষভাবে যুক্ত আছে ওয়াগনার গ্রুপ ও বেসরকারি সামরিক কোম্পানির মাধ্যমে তারা আফ্রিকায় নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চায়, বিশেষ করে রেড সাগরের বন্দর এলাকায়। লিবিয়ার জেনারেল খলিফা হাফতারও আরএসএফকে অস্ত্র ও জ্বালানি সরবরাহ করছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, যাতে সীমান্তবর্তী দারফুর অঞ্চলে লিবিয়ার প্রভাব বজায় থাকে।

মানবিক সংকট ও ভবিষ্যতের শঙ্কা

যুদ্ধের ফলে সুদানের অর্থনীতি কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় আয় কমে গেছে প্রায় ৮০ শতাংশ, এবং মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে কয়েকগুণ। খাদ্য সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) বলছে দুই কোটির বেশি মানুষ বর্তমানে তীব্র ক্ষুধার্ত অবস্থায় আছে। হাসপাতাল, স্কুল, সরকারি দপ্তর সবই বন্ধ বা ধ্বংসস্তূপে পরিণত। চিকিৎসা সেবা বন্ধ, ওষুধ নেই, আর যারা বেঁচে আছে তারা প্রতিবেশী দেশ চাদ, দক্ষিণ সুদান বা মিশরের দিকে পালাচ্ছে।

ছবিঃ Anadolu Ajansı

তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো আন্তর্জাতিক নীরবতা। বড় শক্তিগুলো নিজেরা যুদ্ধে সরাসরি জড়াতে চায় না, আবার মানবিক সহায়তাও যথেষ্ট দিচ্ছে না। ফলে যুদ্ধ শুধু দীর্ঘ হচ্ছে না, বরং আরও জটিল হয়ে উঠছে। একদিকে আরএসএফ নিজেকে “নতুন সরকার” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবি তুলছে, অন্যদিকে সেনাবাহিনী খার্তুম ও পোর্ট সুদান থেকে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে। এর ফলে সুদান আবারও বিভক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যেমনটা হয়েছিল ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদানের জন্মের সময়।

আজকের এই সুদান এক গভীর ট্র্যাজেডি হয়ে দাড়িয়েছে। ক্ষমতার লোভ, জাতিগত বৈরিতা, বিদেশি স্বার্থ সব মিলিয়ে এই দেশটি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের প্রিয়জন হারিয়েছে, কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত, আর শিশুরা বড় হচ্ছে লাগাতার যুদ্ধের নির্মমতায়। কিন্তু বিশ্ব এখনও নিশ্চুপ! যেন মানবতার এই ক্ষতও আগেরগুলোর মতো সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে। অথচ ইতিহাস বলে, এমন নীরবতার মূল্য একদিন সবাইকেই দিতে হয়।

তথ্যসূত্র:

  • BBC News, “Sudan conflict: How it started and where it’s heading”, 2024
  • Al Jazeera, “Darfur: The RSF’s ethnic violence and UAE’s shadow role”, 2024