শরীয়াহ আইন পর্যালোচনা পর্ব–১

মানব সভ্যতার ইতিহাসে আইন ও নৈতিকতা সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিটি জাতি ও সভ্যতা নিজেদের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করেছে, যাতে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, অধিকার ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট থাকে। কিন্তু মানুষের তৈরি আইন সময়, স্থান ও ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়। এর বিপরীতে ইসলামী শরীয়াহ আইন মানুষের বানানো নয়; বরং এটি আল্লাহ প্রদত্ত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এজন্য শরীয়াহ আইন শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি ন্যায়নিষ্ঠ ও চূড়ান্ত জীবন ব্যবস্থা।

শরীয়াহ শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ: “শরীয়াহ” শব্দটি এসেছে আরবি “شرع” (শরআ) ধাতু থেকে। এর আক্ষরিক অর্থ হলো—“সুস্পষ্ট রাস্তা”, “জলপথ” বা “পথনির্দেশ”। ইসলামী পরিভাষায় শরীয়াহ বলতে বোঝানো হয় সেই নির্দিষ্ট জীবনধারা, যা আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে দিয়েছেন, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে এবং পার্থিব ও পরকালীন সফলতা অর্জন করতে পারে।
ইসলামী আইনবিদ ইবনে মানযুর তার “লিসানুল আরব”-এ উল্লেখ করেছেন যে, শরীয়াহ হলো এমন একটি রাস্তা, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন, যাতে তারা দুনিয়াতে শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ করে।

ইসলামী শরীয়াহর সংজ্ঞা:
শরীয়াহ আইনের বহু সংজ্ঞা পাওয়া যায়। বিভিন্ন আলেম ও ফকীহগণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সংজ্ঞা দিয়েছেন।

  1. ইমাম শাফিঈ (রহ.)বলেন:
    “শরীয়াহ হলো কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কিয়াসের মাধ্যমে প্রাপ্ত সেই বিধান, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ প্রদত্ত।”
  2. ইমাম গাজ্জালী (রহ.)বলেছেন:
    “শরীয়াহ হলো আল্লাহ প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের ধর্ম, জীবন, জ্ঞান, বংশ এবং সম্পদ রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করে।”
  3. আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেন:
    “শরীয়াহ আইন হলো এমন এক পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা, যেখানে আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের সকল ক্ষেত্রের জন্য বিধান রয়েছে।”

অতএব সংক্ষেপে বলা যায়, শরীয়াহ আইন হলো আল্লাহ প্রদত্ত সেই পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, যা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদান করে।

শরীয়াহ আইনের বৈশিষ্ট্য:
শরীয়াহ আইনকে অন্য যে কোনো মানবসৃষ্ট আইন থেকে ভিন্ন ও শ্রেষ্ঠ করে তোলে তার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

  1. আল্লাহপ্রদত্ত – এটি মানুষের তৈরি নয়, তাই এখানে কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ, পক্ষপাতিত্ব বা পরিবর্তনশীলতার প্রভাব নেই।
  2. সর্বজনীন – শরীয়াহ কেবল আরবদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য।
  3. পূর্ণাঙ্গতা – মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব দিকের জন্য বিধান আছে।
  4. স্থিতিশীলতা ও নমনীয়তা – মূলনীতি চিরস্থায়ী, তবে প্রয়োগে সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ইজতিহাদের সুযোগ রয়েছে।
  5. ন্যায় ও সমতা – নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, শাসক-শাসিত সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
  6. আধ্যাত্মিকতা ও জাগতিকতার সমন্বয় – শরীয়াহ শুধু ইবাদত নয়, বরং সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়েও দিকনির্দেশনা দেয়।

শরীয়াহ আইন বনাম মানবসৃষ্ট আইন:
মানবসৃষ্ট আইন সাধারণত মানুষের বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও স্বার্থের ওপর নির্ভর করে তৈরি হয়। এর ফলে সময়ের সাথে সাথে এগুলো পরিবর্তিত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে অন্যায় বা বৈষম্যের জন্ম দেয়। উদাহরণস্বরূপ—
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক আইনব্যবস্থা মূলত উপনিবেশবাদ ও শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় তৈরি হয়েছিল।
আধুনিক রাষ্ট্রে অনেক আইন তৈরি হয় রাজনৈতিক সুবিধা বা বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে।
কিন্তু শরীয়াহ আইন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, তাই এতে কোনো ধরনের পক্ষপাত বা অসাম্য নেই। এর উদ্দেশ্য হলো—
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
মানুষের কল্যাণ সাধন
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা

শরীয়াহ আইনের উদ্দেশ্য:
ইসলামী ফিকহবিদগণ শরীয়াহ আইনের মূল লক্ষ্যকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছেন:

  1. ধর্ম রক্ষা – ইবাদত ও আধ্যাত্মিক জীবন সুরক্ষা।
  2. জীবন রক্ষা – হত্যা, অন্যায় আক্রমণ, অপরাধ থেকে নিরাপত্তা।
  3. জ্ঞান/বুদ্ধি রক্ষা – মাদক, নেশাজাতীয় দ্রব্য নিষিদ্ধকরণ।
  4. বংশ রক্ষা – বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার, পরিবার ব্যবস্থা।
  5. সম্পদ রক্ষা – চুরি, ডাকাতি, সুদ নিষিদ্ধকরণ, হালাল বাণিজ্যের অনুমোদন।

এই পাঁচটি মৌলিক লক্ষ্য মানব জীবনের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও উন্নতির জন্য অপরিহার্য।

শরীয়াহ আইনের প্রভাব:
শরীয়াহ আইন ব্যক্তি ও সমাজ উভয় স্তরে গভীর প্রভাব বিস্তার করে—
ব্যক্তিগত জীবন – মানুষকে ইবাদত, নৈতিকতা ও শৃঙ্খলার পথে পরিচালিত করে।
পারিবারিক জীবন – বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ও খোরপোষের সুনির্দিষ্ট নিয়ম স্থাপন করে।
অর্থনৈতিক জীবন – সুদ নিষিদ্ধ করে ন্যায়নিষ্ঠ অর্থনীতি গড়ে তোলে, যাকাত ও সদকার মাধ্যমে সম্পদ বণ্টনের ভারসাম্য আনে।
সামাজিক জীবন – প্রতিবেশী অধিকার, দরিদ্রদের সহায়তা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।
রাষ্ট্রীয় জীবন – শাসকের দায়িত্ব, বিচারব্যবস্থা, অপরাধ দমন ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা।

শরীয়াহ আইন কোনো সাধারণ আইন নয়; এটি আল্লাহপ্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এর সংজ্ঞা শুধু আইনগত নয়, বরং আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থেও গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী শরীয়াহর প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির কল্যাণ, ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা। তাই শরীয়াহ আইনকে বোঝা মানে শুধু ইসলামী আইন জানা নয়, বরং একটি সমন্বিত ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনব্যবস্থা বোঝা।