জড়বাদী আগ্রাসনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঈমানদার সম্প্রদায়
শরিফুর রহমান আবিদ
ঈমান একটি ধারা। কুফর একটি ধারা।
কেউ ঈমান গ্রহণ করে মুমিন হবে নয়তো কুফর গ্রহণ করে কাফের হবে।
এটা অতি স্বাভাবিক নিয়ম। এবং এটাই হওয়া উচিত।
কিন্তু আমরা গভীর ভাবে লক্ষ্য করছি ঈমান ও কুফরের মাঝখানে তৃতীয় আরেকটি ধারা এদেশের মুসলিমরা আঁকড়ে ধরে আছে তা হল “জড়বাদী ধারা”।
অর্থাৎ তারা পূর্ণরূপে ঈমানও গ্রহণ করছে না আবার কাফেরও হচ্ছে না , মাঝখানে তৃতীয় পথ আবিষ্কার করে নিয়েছে অথচ তারা নিজেদেরকে ঈমানদার দাবি করেই চলছে। কিন্তু ঈমান গ্রহণ করার পর এরকম কোনো সুযোগ ইসলামে বিলকুল নেই।
এদের বেশিরভাগই জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এই অজ্ঞতায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে আবার জাতির ওলামাদের বিশাল একটা অংশও জড়বাদী হয়ে পড়েছে।
তাদের কথা শুনলে মনে হবে এই পার্থিব জীবনই শুরু এবং এটাই শেষ ।পরকাল বলতে কিছু নেই।
যেন দুনিয়ার সফলতাই প্রকৃত সফলতা এর পরে সফলতা বলতে আর কিছু নেই।
জড়বাদী মতবাদ মূলত কুফুরি মতবাদ সমূহেরই একটি শাখা। তাদের কথাবার্তা , চিন্তাধারা, চালচলন প্রাক ইসলামী যুগের আরবের মুশরিকদের সাথে হুবহু মিলে যায় ।
কোরআনের ভাষায়-
اَفَرَءَیْتَ مَنِ اتَّخَذَ اِلٰهَهٗ هَوٰىهُ وَ اَضَلَّهُ اللّٰهُ عَلٰى عِلْمٍ وَّ خَتَمَ عَلٰى سَمْعِهٖ وَ قَلْبِهٖ وَ جَعَلَ عَلٰى بَصَرِهٖ غِشٰوَةً ؕ فَمَنْ یَّهْدِیْهِ مِن ۢ ْ بَعْدِ اللّٰهِ ؕ اَفَلَا تَذَكَّرُوْنَ
তুমি কি কখনো সেই ব্যক্তির অবস্থা ভেবে দেখেছো যে তার প্রবৃত্তির কামনা বাসনাকে খোদা বানিয়ে নিয়েছে আর জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তাকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন, তার দিলে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং চোখে আবরণ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে তাকে হিদায়াত দান করতে পারে? তোমরা কি কোন শিক্ষা গ্রহণ করো না?
وَ قَالُوْا مَا هِیَ اِلَّا حَیَاتُنَا الدُّنْیَا نَمُوْتُ وَ نَحْیَا وَ مَا یُهْلِكُنَاۤ اِلَّا الدَّهْرُ ۚ وَ مَا لَهُمْ بِذٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ ۚ اِنْ هُمْ اِلَّا یَظُنُّوْنَ
এরা বলেঃ জীবন বলতে তো শুধু আমাদের দুনিয়ার এই জীবনই। আমাদের জীবন ও মৃত্যু এখানেই এবং কালের বিবর্তন ছাড়া আর কিছুই আমাদের ধ্বংস করতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে এদের কোন জ্ঞান নেই। এরা শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে এসব কথা বলে।
সূরা : জাসিয়া, আয়াত: ২৩-২৪.
ঈমানদারদের মূল টার্গেট হওয়া উচিত আখেরাত।
কিন্তু জড়বাদী চিন্তাভাবনায় আক্রান্ত হওয়ার ফলে এদেশের অধিকাংশ মুসলিম দুনিয়াকে মূখ্য টার্গেটে পরিনত করেছে। যেমনটা আল্লাহ বলেছেন –
بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا٘ۖ
বরংচ তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকো।
وَ الْاٰخِرَةُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰىؕ
অথচ আখেরাত উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।
সূরা-আ’লা, আয়াত: ১৬ , ১৭.
জাতি হিসেবে মুসলিমরা হলো সবার সেরা
كُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ
তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদেরকে বের করা হয়েছে জনগণের (উভয় জগতের) কল্যাণ সাধনের জন্যে।
আলে-ইমরান, আয়াত: ১১০
চিন্তার জগতে জড়বাদী হওয়ার কারণে মুসলিমরা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে হীন জাতিতে পরিনত হয়েছে।
যেমন ঝড়বাদীদের স্বভাব হল শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা। নিজে শান্তিতে থাকতে পারলেই হলো। এই সংকীর্ণ চিন্তার প্রভাবে মুসলিমদের মধ্য থেকে বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক , বিজ্ঞানী বের হচ্ছে না।
জন্মের পর থেকেই প্রতিটা মুসলিম সন্তানকে শেখানো হচ্ছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে আর সেই প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ মানদন্ড হলো একটা সরকারি চাকরি।
ফলশ্রুতিতে মুসলিম সন্তানদের চিন্তাভাবনা সরকারি চাকরি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
চিন্তার জগতে এর বাইরে তারা বের হতে পারছে না।
তাকে সীমারেখা শেখানোই হয়েছে সরকারি চাকরি , তো সে বিশ্ব বিখ্যাত হবে কিভাবে?!
আর এই জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ার কারণেই মুসলিমরা গোটা বিশ্বে পিছিয়ে পড়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন-
یَرْفَعِ اللّٰهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ ۙ وَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجٰتٍ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা আল্লাহ ( বিশ্বময় ) উন্নীত করবেন। বস্তুত আল্লাহ তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত।
সূরা: মুজাদিলাহ, আয়াত: ১১.
জড়বাদী চিন্তাভাবনার প্রভাবে মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল গ্রন্থ আল কোরআন থেকেও দূরে সরে পড়েছে।
সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো ওলামাদের বিশাল এক অংশও জড়বাদী চিন্তাভাবনা লালন করে!
- যেমন বর্তমানে দেশের অধিকাংশ আলিয়া মাদ্রাসা যেন স্রেফ একটা কর্মসংস্থানে পরিণত হয়েছে ।
শিক্ষকদেরই বিশাল এক অংশ এটাকে দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মনেও করছে না।
ফলশ্রুতিতে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এই যে ,
আলিয়া মাদ্রাসায় শুধু আলেম হওয়ার নিয়তে যাওয়াই যেন একটা যুদ্ধের শামিল!
স্রেফ ইলম অর্জনের নিয়তে কেউ যদি শুধু আলিয়া মাদ্রাসার উপরের ক্লাসগুলোতে অধ্যয়ন করে তাকে মনে করা হয় , সে পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা লোক!
কারণ সে ভার্সিটিতে না গিয়ে এখানে কি করে!
এই লোকগুলো জড়বাদী চিন্তাভাবনায় আচ্ছন্ন হওয়ার ফলে ইলমে ওহীকে গুরুত্ব দিতে পারছে না বরং জাগতিক বিষয়কে অধিক গুরুত্বারোপ করছে।
(তাদের সংখ্যাটা বেশি , এর বাহিরেও সঠিক ধারায় আছে অনেক লোক)
আর আজকের এই প্রজন্মের বাস্তবতা হল , আলিয়া জগতে ইলমে ওহী ধারণ করার লোক প্রায় শূন্যের কোঠায়!
এখান থেকে যারা স্কলারশিপ পেয়ে বহির বিশ্বে যাচ্ছে তাদের মধ্য থেকে নিরেট ইলম অর্জনের জন্য যাচ্ছে এরকম সংখ্যাটা কম। মূলত তারা যাচ্ছে বহির বিশ্বে পড়াশোনা করে আসলে সামাজিক মর্যাদা পাওয়া যায় এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে!
কে হাল ধরবে এ জাতির?! কোন দিকে যাচ্ছে এরা?!
আজ থেকে ২০ বছর পরে এখানে কে বুখারী মুসলিমের মত কিতাবের দারস দিবে?! কয়জনই বা আছে?! যারা আছে তাদের সংখ্যাটা যথেষ্ট নয় তো!
- ইলমের আলোচনায় আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কওমী মাদ্রাসার অবস্থান অনেক ভালো।
কিন্তু একথা সত্য এখানেরও বিশাল এক অংশ গতানুগতিক জড়বাদী চিন্তা-ভাবনা লালন করে।
যেমন :
কওমী মাদ্রাসার বিশাল এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে বক্তা হওয়ার টার্গেট নিয়ে।
যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কেন বক্তা হবে?
উত্তরে বলে এখানে টাকা বেশি!
বক্তা হওয়া দোষের কিছু নয় তবে এই নিয়তে বক্তা হওয়া অবশ্যই মারাত্মক দোষের!
এদেরই আর এক অংশ দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়ার নেশায় আসক্ত । এর জন্য যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে। - এদেশের সামাজিকতার অবস্থা আরো ভয়াবহ।
এরা জড়বাদী হওয়ার কারণে এদের নিজস্ব কোন মত পথ নাই। বরং যেদিকে একটু লাভ দেখে ওইদিকেই দৌড় দেয়।
যেমন নির্বাচনের আগে এই মানুষগুলোকে ৫০০-১০০০ টাকার বিনিময়ে কেনা যায়।
আবার অনেককে এক প্লেট বিরিয়ানির বিনিময়েই কেনা যায়!
এরা অতিমাত্রায় দুনিয়াদারী জড়বাদী হওয়ার কারণে এদের সামনে যদি কেউ জান্নাতের সার্টিফিকেটও পেয়ে যায় তবুও এটা তাদের কাছে কোন বিষয়ই মনে হয় না!
কিন্তু কেউ যদি আমেরিকার নাগরিকত্ব পায় কিংবা শুধুমাত্র আমেরিকা যেতে পারে এটা তাদের কাছে বিশাল কিছু মনে হয়!
কোরআনে হাফেজরা শতশত দেশকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশের সুনাম বিশ্বে সমন্বিত করার পরেও এটা তাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয় মনে হয়।
কিন্তু ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলায় জাস্ট একটা সাধারন বিজয় অর্জন করতেই এরা শহর জোরে বিজয় মিছিল দিতে ভুল করে না।
ইলমে ওহী ও ইলমে নববী যারা বক্ষে ধারণ করে তাদেরকে খুব সাধারণ ভাবা হয়।
কিন্তু কেউ যদি কোনো ভার্সিটিতে চান্স পায় কিংবা স্কলারশিপ পায় সেটা হোক না কোনো হীন বিষয়ে (যেমন অনেকে মিউজিকে স্কলারশিপ পায়, আবার কেউ কেউ ডান্স শিখার স্কলারশিপ পায়!)! তাকেও দুনিয়া জুড়ে হাইলাইট করা হয়!
কাবার ইমাম এ দেশে এসে নীরবে চলে যায় কেউ জানেও না , কিন্তু খ্রিস্টানদের পোপ আসলে শহরজুড়ে নানান আমেজ চলে!
এভাবেই চলছে। এ জাতির যেন সবকিছু এই দুনিয়াতেই শুরু আর এই দুনিয়াতেই শেষ।
অপরদিকে আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে এরকম মানুষের সংখ্যা অল্পসংখ্যক!
وَ مِنَ النَّاسِ مَنْ یَّشْرِیْ نَفْسَهُ ابْتِغَآءَ مَرْضَاتِ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ رَءُوْفٌ ۢ بِالْعِبَادِ
অন্যদিকে মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অভিযানে যে নিজের প্রাণ সমর্পণ করে। এই ধরনের বান্দার ওপর আল্লাহ অত্যন্ত স্নেহশীল ও মেহেরবান।
সূরা-বাক্বারাহ, আয়াত: ২০৭
মুসলিমরা যতদিন পর্যন্ত জড়বাদী চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত ছিল ততদিন পর্যন্ত বিশ্বময় মর্যাদার আসনে আসীন ছিল।
যেদিন থেকে দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু করেছে সেদিন থেকেই ধ্বংসের শুরু হয়েছে।
আল্লামা ইকবাল রহ. আফসোস করে বলেছিলেন-
کبھی اے نوجواں مسلم! تدبر بھی کیا تو نے وہ کیا گردوں تھا تو جس کا ہے اک ٹوٹا ہوا تارا مجھے اس قوم نے پالا ہے آغوش محبت میں کنچل ڈالا تھا جس نے پاؤں میں تاج سرِ دارا
ভালোবাসার আঁচলে তোমাকে বড় করেছিল এক জাতি, যারা অবজ্ঞা ভরে পায়ে মাড়িয়েছিল পারস্যের মুকুটকে। কখনো হে মুসলিম যুবক! ভেবে দেখেছ কি তুমি, আসমানের ঝরে পড়া সে তারাগুলোর তুমিও একটি ছিলে?!
শরিফুর রহমান আবিদ
শিক্ষার্থী : তা’মিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা টঙ্গী।