
‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালো-মন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’
একজন কবি! স্মৃতিময় জীবন পার করে সময় সন্ধিক্ষণে এসে তিনি কল্পনা করছেন, এমন এক শুভ শুক্রবারের ভোরের, যেদিন রাতের শেষে ভোরের আলোর স্নিগ্ধতায় ডাক আসবে মৃত্যুর ফেরেশতার। কবি নিঃশঙ্কচিত্তে সানন্দে অনুভব করবেন পরম প্রশান্তি। কবিতার ছন্দের আলোকে কি সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন মৃত্যুর স্বর্গীয় দিককে। ঠিক যেমন করেছিলেন কবি নজরুল।
আজকের এই কবি সোনালি কাবিনের কবি, আধুনিক বাংলা কবিতার রূপকার কবি আল মাহমুদ। বখতিয়ারের ঘোড়া ছুটিয়ে যিনি তুমুল বেগে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গণ।
বঞ্চিত কবি! মতাদর্শের জালে ফেলে সঙ্কীর্ণ বাঙালি সাহিত্য সমাজ তাকে সবসময় চাপিয়ে রাখতে চেয়েছে একপাশে। কিন্তু না, কালের কলস বিদীর্ণ করে বখতিয়ারের ঘোড়ায় চেপে লোক লোকান্তর পেরিয়ে মায়াবী পর্দা দুলিয়ে কবি এগিয়ে গিয়েছেন সগর্বে স্বরূপে।
কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া–
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!
আমরা অতীতের রোমন্থন করি। একটা সময় স্মৃতিকাতর হই। কবিরাও হয়। স্মৃতিকাতরতা তাদের বড্ড পিছু টানে। ফেলে আসা সেই সোনালী অতীতকে কবি তুলে এনেছেন কি আবেগময় স্মৃতি বিজড়িত ছন্দে।
স্কুল জীবনে আল মাহমুদের কবিতার সাথে পরিচয় হয়
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।
এই কবিতার মাধ্যমে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে স্কুলের অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতাম এই কবিতাটি। আহা কি ছন্দ। বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস কবি তুলে এনেছেন এক কবিতায়।
তবে প্রেমময় আকাঙ্খায় কবি ছিলেন অকপট। প্রেম, প্রকৃতি ও নারী, জীবনের অনুষঙ্গ সবই যেন একাকার হয়ে গিয়েছিলো আল মাহমুদের কবিতায়। প্রগাঢ় অর্থবহতা, শব্দরচনা, বাক্যরীতি বাংলা কবিতায় সৃষ্টি করেছে এক নতুনত্বের পদচারণা। তবে তার আবেগ ছিলো নিয়ন্ত্রিত। সুষম আবেগকে তিনি বেঁধেছেন কবিতার নিয়ন্ত্রিত ছন্দের জালে।
তাঁর কবিতা গুলো জীবন দর্শী। তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন নিজস্ব একটা প্রকাশভঙ্গী, যেমনটা দেখা যায় জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। জীবনকে কবিতার ছন্দে জড়িয়ে তোলায় এই দু’জনের অবদান সর্বোচ্চ।
কবিকে বারবার দমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু না। কবি দমে যান নি। কবির কবিতা এগিয়ে নিয়ে চলেছে কবিকে। আজও পাঠকপ্রিয়তা বাড়ছে কবির কবিতার। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি মোল্লা বাড়ির পিয়ারু মীর আবদুস শুক্কর আল মাহমুদ কে। আল্লাহ যেন তাঁকে নাজাত দান করেন সেই দোয়াই করি।