বৃহস্পতিবার, মে ২২, ২০২৫
নিউজ পাঠান
বৃহস্পতিবার, মে ২২, ২০২৫
নিউজ পাঠান

নাকবা: একটি জাতির বিপর্যয় ও ইতিহাসের দায়

৭৭ বছর আগে, ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনি জনগণের জীবনে নেমে আসে ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়। এটি কোনো স্বাভাবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল না, বরং একটি সুপরিকল্পিত দখল ও উৎখাতের ইতিহাস, যার মূল চিত্র উঠে এসেছে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের বিবরণে।

নাকবার প্রেক্ষাপট বুঝতে গেলে ফিরে যেতে হয় ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণায়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এই ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে একটি “ইহুদি জাতীয় গৃহ” প্রতিষ্ঠার সমর্থন জানালে জায়নবাদী আন্দোলন পায় উপনিবেশিক সমর্থন। ঐতিহাসিক রশিদ খালিদি তাঁর The Hundred Years’ War on Palestine (2020) গ্রন্থে লিখেছেন, বেলফোর ঘোষণাটি ছিল একটি আন্তর্জাতিক শক্তির পক্ষ থেকে এমন এক জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়া, যার সেই অঞ্চলে বসবাসকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কোনো সম্মতি ছিল না।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের বিভাজন প্রস্তাব ও এর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদকে দমন করতে জায়নবাদী মিলিশিয়ারা একাধিক ‘অপারেশন প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করে। এই প্রেক্ষাপটে ইলান পাপে তাঁর The Ethnic Cleansing of Palestine (2006) বইয়ে দেখান, কীভাবে ‘প্ল্যান ডালেত’ নামে পরিচিত একটি সামরিক কৌশলের মাধ্যমে শত শত গ্রাম ধ্বংস করা হয় এবং প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে উৎখাত করা হয়। পাপে এই ঘটনাকে “জাতিগত নির্মূল” হিসেবে অভিহিত করেন।

জায়নবাদী মতাদর্শের গোড়াপত্তনের জন্য থিওডর হারজেলের ভূমিকা ছিল মুখ্য। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তাঁর Der Judenstaat (The Jewish State) বইয়ে তিনি বলেন, ইহুদি জনগণের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রয়োজন, এবং ফিলিস্তিনই তার উপযুক্ত স্থান। হারজেলের এই ধারণা, যা ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ফিলিস্তিনে বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হয়। ইহুদি পুনর্বাসনের জন্য ভূমি কেনা, সশস্ত্র প্রস্তুতি, এবং রাজনৈতিক লবিং ছিল সেই প্রকল্পের অংশ।

তবে এ ইতিহাসের একমাত্র পাঠ শুধু ইসরায়েলের রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা নয়; বরং ফিলিস্তিনি জনগণের উচ্ছেদ, উদ্বাস্তু জীবন, এবং বর্তমান দখলদার নীতির ধারাবাহিকতা বোঝা। আজকের গাজা, পশ্চিম তীর কিংবা আল-কুদস—সবই সেই ১৯৪৮ সালের নীতির ধারাবাহিক বাস্তবায়ন। ইলান পাপে তাঁর আরেকটি বই, Ten Myths About Israel (2017)-এ বলেন, ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে—যেখানে একটি ‘খালি জমি’তে ‘চাষের’ গল্প বলা হয়, অথচ বাস্তবে সেটি ছিল একটি সজীব সংস্কৃতি ও জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি।

এই প্রেক্ষাপটে নাকবা কেবল ইতিহাসের একটি দিন নয়, বরং একটি চলমান প্রক্রিয়া—যেখানে ভূমি দখল, জাতিগত ভিন্নতা নির্মূল এবং রাজনৈতিক বৈষম্য একত্রে কাজ করে। আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতা কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান এই সংকটকে আরও দীর্ঘায়িত করেছে।

 আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, এই প্রশ্নটি আগের চেয়ে আরও প্রাসঙ্গিক: ইতিহাস কি শুধু বিজয়ীদের লেখা হবে, নাকি নিপীড়িতদের বয়ানও বিশ্বশ্রুত হবে? ফিলিস্তিনিদের নাকবা সেই বয়ানেরই এক জ্বলন্ত দলিল।

লেখক : আব্দুল বাশির
শিক্ষার্থী, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির

পাঠকপ্রিয় অনলাইন পোর্টাল দিগন্তকণ্ঠ.কমে লিখতে পারেন আপনিও।

লেখার বিষয় সাহিত্য, ফিচার, প্রবন্ধ, মতামত, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি।

আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন digantakantho@gmail.com ঠিকানায়।

- বিজ্ঞাপন -spot_img

এ সম্পর্কিত আরো