ইসলামো-ফিলিয়া – পর্ব পাঁচ

|| ইসলামো-ফিলিয়া ||

হুমাইয়া ছালছাবিল ফাইজা

[পাঁচ]

—এ হইলো পৌরাণিক পৃথিবী বুঝলি নোমান, এখানে একবার ঢুকলে বের হতে পারবি না।

বলছেন মনির স্যার আত্মবিশ্বাসী হয়ে।

—আপনার পর্যবেক্ষণ সবসময়ই অন্যরকম স্যার, ভিখারীদের মধ্যেও ডায়নোসরের ফসিল খুঁজে পান।

বলে উঠল নোমান।

পথে হাঁটতে হাঁটতে নোমানের দেখা হয়ে গেল হাইস্কুলের অঙ্কের টিচার মনির স্যারের সঙ্গে। বরাবরই গম্ভীর, নমনীয়, ফিলোসফি আওড়ানো মানুষ ছিলেন তিনি। এত বছর পরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে কিশোর নোমান যে স্যারকে ভয় করে চলতো সে স্যারকে দেখা যাচ্ছে না, এখন সম্পূর্ণ অন্য একজন মানুষ লাগছে। মানুষকে সবচেয়ে বেশি আলাদা লাগে ওজন কমলে কিংবা বাড়লে, স্যারের মাঝে সেসবের লক্ষণ নেই। সম্ভবত ওনার ওজন দশ বছর আগে যা ছিল এখনো তাই আছে। চামড়ায় বয়সের ভাঁজও তেমন পড়েনি। তারপরও মনির স্যারকে একেবারে অন্য কারো মতো মনে হচ্ছে। কার মতো? নোমান নিবিড় হয়ে নিজেকে প্রশ্নটা করছে।

—ডায়নোসরের ফসিলও সহজলভ্য। এই ভিক্ষুক সমাজের হদিশ পাওয়া তার চাইতেও কঠিন। তুই হয়তো জানিস না, আমি ভিখারী সমাজের বাসিন্দা হওয়ার খুব চেষ্টা করছি। অবশ্য তোর না জানারই কথা। কতদিন বাদে দেখা হচ্ছে বল তো?

—নয় বছর তো হবেই। কিন্তু আপনার এমন অদ্ভুত চেষ্টার কারণ বুঝতে পারলাম না স্যার…।

—অদ্ভুত না রে, বাস্তবিক চেষ্টা। বাস্তব সংখ্যায় অমূলদ-মূলদ সংখ্যার পাঠ মনে আছে তোর? নাকি সব গুলে খেয়ে বসে আছিস? আমার জীবনটা দিনকে দিন অমূলদ সংখ্যা হয়ে যাচ্ছে রে, শেষই হতে চায় না। দশমিকের পর নানারূপী সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। এর থেকে মুক্তি পাওয়াটা খুব দরকার, ভীষণ দরকার।

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে মনির স্যার ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন।
আর নোমান সেই আগেকার ক্লাসরুমে বসে পড়া বোঝার মতো করে স্যারের দিকে তাকাল। বোধহয় আরো কিছু বলতে চাইলেন তিনি কিন্তু হৃদয়ের কাঁটা গলায় এসে আটকে গেল।
প্রমী হয়তো ইতিমধ্যে বাড়ির সদর দরজার সামনে পৌছে গেছে, ওর হয়তো আজো মন ভেঙেছে নোমান আর একটু সময় দেয়নি বলে। ও চেয়েছিল রিকশায় ওর পাশে নোমান বসবে, খুব ধীরে চলবে রিকশার চাকা। ধীরগতির চাকায় ঘুরতে থাকবে দুজনের একঘেয়ে অথচ অমলিন কথাবার্তা। কিন্তু বরাবরের মতো নোমান রিকশা ডেকে এনে প্রমীকে তুলে দিলো, রিকশায় উঠে প্রমী অভিযোগের ছাপ থাকা চাহনির দ্বারা বুঝিয়ে দিতে চাইল ‘একা একটা মেয়ের পথে পথে বিপদ তাই তোমার আমার সাথে যাওয়া উচিত’। নোমান চাহনির ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষা অনুবাদ করে জবানে জবাব দিলো যে ‘লোকজনের আনাগোনা আছে এমন পথে বিপদের আশঙ্কা কম থাকে, আর তোর বাড়ি খুব একটা দূরে নয়। তাই যেতে পারবি নিরাপদে।’

নিরাপত্তা। বেশ জটিল সমীকরণ। পৃথিবীর বুকে এ শব্দের ব্যবহার সচরাচর হলেও, এর প্রয়োগের ব্যাপারে মানুষকে সোচ্চার হতে কম দেখা যায়; ইহকাল জুড়ে পরকালের ছবি আড়ালে থেকে যায়।

—স্যার আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না, আপনি কি কোনো সংকটের মধ্যে আছেন?

নোমান বলল ভ্রু কুঁচকে।

—সংকট চিরকাল ছিল। আজো আছে। এখন শুধু বাঁচার পথ পেয়েছি আরকি।

মনির স্যার বললেন এক গ্লাস পানি গলায় ঢেলে।

—ভিক্ষুক সমাজের একজন হতে পারলেই বাঁচার পথ পাওয়া হবে?

—হুম, আলবত হবে। ভিখারীরা দুনিয়ার ভিতর সবচেয়ে বেশি সুখী। তারা অন্য মানুষের ঘৃণা-মোহব্বত দুটোই পায়। তবে তাদের মধ্যে অন্য মানুষের প্রতিক্রিয়ার প্রভাব পড়ে না। আমিও একটা মানবীয় প্রভাবশূন্য জীবন চাই। যে জীবন হবে ফড়িংয়ের, দোয়েলের। মানুষের সাথে যার হয় নাকো দেখা…।

—মানুষের সাথে মুখোমুখি হতে আমরা এত ভয় পাই কেন স্যার? আমরাও কি মানুষ নই?

—আমরাও মানুষ। কিন্তু পরাধীন মানুষ। ভিক্ষুক ছাড়া পৃথিবীর সব মানুষ পরাধীন।
ওই যে দেখো! সামনের ফুটপাতে বসে একজন ফকির তসবীহ জপতেছেন। ওনার তসবীহ জপার আওয়াজ পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাধীন ধ্বনি। থালায় একশো সাতটা টাকা উঠেছে, তার মধ্যে পঞ্চাশ যাবে দলের মুরুব্বির নিকট। হাতে থাকবে সাতান্ন, কম কিন্তু না। দিব্যি রাতের আহার সারা হয়ে যাবে। উনি রিজিক নিয়ে ভাবছেন না, ভাবছেন ছোটবেলার কথা। যখন প্রথম আলিফ-বা-তা-ছা শেখা শুরু করেছিলেন, তখনকার ছবি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

টঙের চায়ের দোকানের ঠিক সামনেই সোডিয়াম লাইটের নিচে জ্বলজ্বল করছে ফুটপাতের সরু রাস্তা। সেখানে বসে আছেন ষাটোত্তীর্ণ এক ফকির। ত্বক ক্ষয়ে গেছে, মুখ বিমর্ষতার প্রতীক হয়েছে। তবুও রুহের তারুণ্যে কোনো খামতির ভাঁজ পড়েনি।

চলবে…

নিউজটি শেয়ার করুন