সোমবার, জুন ২৩, ২০২৫
নিউজ পাঠান
সোমবার, জুন ২৩, ২০২৫
লেখা পাঠান

যিনি স্বপ্ন দেখতেন সমাজগঠনের : শাহ্ আবদুল হান্নান

কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের জীবনের আলো শব্দে-নিঃশব্দে, গোচরে-অগোচরে অজস্র হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরা চলে যান, কিন্তু থেকে যায় তাঁদের চিন্তা, নীতি, বিশ্বাস ও আদর্শ। শাহ্ আবদুল হান্নান ছিলেন তেমনই একজন আলোকবর্তিকা, যিনি তাঁর অপরিসীম ন্যায়নিষ্ঠার দীপ্ত আলোয় চিন্তাশীল মানুষকে পথ দেখিয়ে গেছেন।

কর্মজীবনে তিনি একজন আমলা হলেও সেটি ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক জনদরদী চিন্তাবিদ, সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণের কারিগর। শাহ্ আবদুল হান্নান ইসলামী চিন্তা ও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান—এই দুই মেরুর মধ্যে এক সুতায় বন্ধনের কারিগর।

জীবনব্যাপী অধ্যয়ন, অনুবাদ, চিন্তাচর্চা আর সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে তিনি ইসলামকে কেবল কথিত আবরণে আবদ্ধ নয়, বরং সমাজে তার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর হাতে গড়ে ওঠে ‘ইসলামী ব্যাংকিং’, ‘ওয়াকফ’, ‘কর্জে হাসানা’র মতো ন্যায্যতা-ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এর পাশাপাশি তিনি নারীর কর্মজীবন, পোশাক ও সম্পত্তির অধিকার, ইসলামী বয়ান ও বর্তমান প্রেক্ষিতের আলোকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন।

তাঁর জীবন ও কর্মের পরিসর বিবেচনা করলে দেখা যায় যে তিনি ইসলামকে শুধু আনুষ্ঠানিকতার ধর্ম হিসেবে দেখেননি, তিনি ইসলামকে দেখেছেন একটি জীবনব্যবস্থা হিসেবে। এই বিশ্বাস থেকে তিনি গড়ে তুলেছেন বহু প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন ও চিন্তার মঞ্চ। তাঁর বিচরণক্ষেত্রগুলো ছিল মূলত চিন্তার এক অবারিত পাঠশালা। যার প্রতিফল দেখা যায় তাঁর রচিত লেখাগুলোতে। সেখানে তিনি কুরআনের মর্মবাণী অনুধাবন করে, হাদীসের প্রাসঙ্গিকতা, ফিকহের বাস্তবসম্মত প্রয়োগ, আর বর্তমান সমাজের জটিল বাস্তবতায় ইসলামের আলোকবর্তিকারূপ ভূমিকা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন।

তাঁর রচিত ‘ইসলামী উসূলে ফিকহ্’ নামক আইনশাস্ত্রের গ্রন্থটি এই চিন্তাধারার এক চমৎকার উদাহরণ, যেখানে তিনি একদিকে ইসলামী আইনশাস্ত্রের গভীরতা, অন্যদিকে এর প্রাসঙ্গিকতা অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। এর বাইরে তিনি আরও ১১টি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর চিন্তাধারা।

শাহ্ আবদুল হান্নান শুধুই একজন লেখক বা চিন্তাবিদ ছিলেন না, ছিলেন একজন স্বপ্নকে বাস্তবে গড়ার রূপকার। তাই তো তিনি তাঁর চিন্তাশীল মননের আলোকে অন্যান্য দিকপালদের সাথে শরিক হয়ে এক এক করে গড়ে তুলেছেন নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান।

দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ইসলামী ব্যাংক কনসালটেটিভ ফোরাম, সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান রয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে তিনি ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ইবনে সিনা নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আর্থসামাজিক উন্নয়নে তিনি ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন, মুসলিম এইড বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন।

এর পাশাপাশি বাংলাদেশে ইসলামী ক্ষুদ্রঋণ, কর্জে হাসানা এবং ওয়াকফ জনপ্রিয়করণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

আজকে আমরা ভ্যাট দেই জিনিসপত্র ক্রয়ে, যেটি বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ। সেটি প্রতিষ্ঠার পেছনেও তাঁর উদ্যমী অবদান রয়েছে।

বাংলাদেশের মিডিয়ায় সুন্দর ও পরিশীলিত মানসিকতার চর্চায়ও তাঁর অবদান রয়েছে। তিনি ছিলেন দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান, যার অধীনে রয়েছে ‘নয়া দিগন্ত’ নামের দেশের বহুল প্রচারিত পত্রিকা ও ফ্যাসিবাদের জুলুমের শিকার হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া টিভি চ্যানেল ‘দিগন্ত টিভি’।

বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন শাহ্ আবদুল হান্নান। তাঁর ও অনন্য সহযোগীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় গড়ে ওঠে দেশের প্রথিতযশা ও গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে মানারাত স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ফ্যাসিবাদের প্রথম জুলুমের শিকার হওয়া দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম। এর প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই নিজ নিজ মতাদর্শকে লালন করে এগিয়ে যাচ্ছে সুন্দর আগামীর পানে। বাংলাদেশের প্রাইভেট শিক্ষাব্যবস্থা বা মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন তিনি ও তাঁর সহযোগীরা। রাজনীতির অভিশপ্ত করালগ্রাসে যখন ভুগছিল দেশের শিক্ষাখাত, তখন তিনি মানসম্মত পরিবেশ, আধুনিক ধারা ও নৈতিকতার সমন্বয়ে সহযোগী হয়ে গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠানগুলো।

অর্থাৎ, বাংলাদেশের ভিত্তির প্রতিটি অঙ্গনে ছিল তাঁর সরব পদচারণা। অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, মিডিয়া, শিক্ষাক্ষেত্র—প্রতিটি জায়গায় তিনি তাঁর মননশীলতার ছাপ রেখে গেছেন।

কিন্তু আফসোস, উদ্যমী এই মানুষটিকে প্রায় এক দশক চরমভাবে চাপে রাখা হয়েছে। বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে তাঁর প্রতিটি কাজে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ও দিগন্ত টিভি। দখল করা হয়েছে নর্থ-সাউথ, মানারাত, এশিয়ান, IIUC-এর ট্রাস্টি বোর্ড। ইসলামী ব্যাংক ও ইবনে সিনাকে দমিয়ে রাখা ও দখলের স্টিমরোলার চালানো হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ।

তবুও আজ দেশের প্রথম সারির তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নর্থ-সাউথ রয়েছে, আদর্শবাদী মনোভাবে প্রতিষ্ঠিত মানারাত, IIUC কাটিয়ে উঠছে ১৬–১৭ বছরের দুঃসহ অত্যাচারের দগদগে ক্ষত। এভাবেই আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সবই। বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে একজন স্বপ্নদ্রষ্টার সাধিত স্বপ্ন।

আমরা তাঁকে হারিয়েছি ২ জুন ২০২১। তিনি দেখেছেন একে একে দখল হয়ে যাচ্ছে তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলো। ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে তাদের ভিত্তি। ৫ই আগস্টের স্বাধীনতার লাল সূর্য দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁর সহচর্য পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আবার স্বমহিমায় ফিরছে।

চার বছর কেটে গেছে, কিন্তু তাঁর চিন্তার অবিশ্রান্ত ধারা এখনও আমাদের মাঝে চলমান। তাঁর রেখে যাওয়া কাজ, চিন্তাশীলতা, বই ও উদ্যোগ সবই আজ একেকটি আলোকবর্তিকা। যারা আজ সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন, যারা ইসলামের সহনশীলতা, প্রজ্ঞা ও মানবিকতার আলো তুলে ধরতে চান সবার মাঝে—তাদের জন্য এক অমূল্য পাথেয় হলো শাহ্ আবদুল হান্নানের রেখে যাওয়া কর্মগুলি।

তাঁর জন্য দোয়া করি। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন। প্রত্যাশা করি, আমাদের চিন্তায়, আমাদের কাজে, আমাদের জীবনে তাঁর রেখে যাওয়া আলো যেন ছড়িয়ে পড়ে। আশা রাখি, আগামীতে প্রতিষ্ঠানগুলো এবারের মতো কার্পণ্য না করে যথাযথ মর্যাদার সাথে আগামী প্রজন্মের নিকট তুলে ধরবে তাঁর জীবন ও কর্মের অনুসরণীয় দিকগুলো।

তথ্যসূত্র: নয়াদিগন্ত, রোয়াক, রকমারি, উসূল আল ফিকহ, ছাত্রসংবাদ, চিন্তা ভাবনা.কম , উইকিপিডিয়া

আরশাদ আল গালিব , সম্পাদক – দিগন্ত কণ্ঠ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন পোর্টাল দিগন্তকণ্ঠ.কমে লিখতে পারেন আপনিও।

লেখার বিষয় সাহিত্য, ফিচার, প্রবন্ধ, মতামত, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি।

আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন digantakantho@gmail.com ঠিকানায়।

- বিজ্ঞাপন -spot_img

এ সম্পর্কিত আরো