১৫ মে ফিরে আসে একটি গভীর বেদনাবিধুর স্মৃতি নিয়ে—নাকবা দিবস। ‘নাকবা’ অর্থ ‘বিপর্যয়’, আর ১৯৪৮ সালের এই দিনে ফিলিস্তিনিদের জীবনে যে দুর্বিষহ অধ্যায় শুরু হয়েছিল, তা মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কগাথা। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ফিলিস্তিনিদের উপর নেমে আসে গণচ্যুতি, নিপীড়ন ও দখলের এক দীর্ঘ অধ্যায়। প্রায় আট লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের জন্মভূমি থেকে জোরপূর্বক উৎখাত করা হয়। ধ্বংস করা হয় শত শত গ্রাম, মুছে ফেলা হয় ফিলিস্তিনিদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অস্তিত্বের বহু নিদর্শন।
এই ঘটনাপ্রবাহ কোনো একদিনের ট্র্যাজেডি নয়, এটি একটি দীর্ঘকালীন ন্যায়বিচারহীনতার ইতিহাস। বিশ্ব রাজনীতি বারবার তাদের দিকে পিঠ ফিরিয়েছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রস্তাব ও প্রতিশ্রুতি রয়ে গেছে অকার্যকর। একদিকে দখলদারিত্বকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে, অন্যদিকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অধিকারের দাবি তুললেই সেই কণ্ঠকে ‘চরমপন্থী’ বা ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
নাকবা এখন আর শুধুই ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়। এটি আজও বর্তমান। গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে প্রতিনিয়ত যে দমনপীড়ন চলছে, তা নাকবারই ধারাবাহিকতা। ঘর হারানো শিশুদের চোখে, অবরুদ্ধ হাসপাতালের করুণ চিত্রে, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মানবতার চিৎকারে আজও প্রতিধ্বনিত হয় সেই একই আর্তনাদ।
এই বিপর্যয়ের দায় এককভাবে কোনো পক্ষের নয়—এর দায় বিশ্ব বিবেকের, দায় সেই সব ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের যারা মানবাধিকারের কথা বলে কিন্তু নিপীড়িতদের পক্ষে দাঁড়াতে ভয় পায়। একটি জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিয়ে কেবল রাজনৈতিক মুনাফা হাসিল করাকে সভ্যতার লক্ষণ বলা যায় না। ইতিহাস একদিন এর জবাব চাইবেই।
এই দিনে, আমাদের উচিত ইতিহাসকে ভুলে না যাওয়া। কেবল স্মরণ করলেই চলবে না, প্রয়োজন ন্যায় ও মানবিকতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া। নির্যাতিতদের প্রতি আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই প্রতিবাদ উঠে আসা দরকার। নাকবা দিবস সেই দায়িত্বের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—একটি জাতি তার ভূমি, তার পরিচয় ও তার ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করছে, আর আমরা কীভাবে সেই লড়াইকে মূল্যায়ন করছি, তা-ই ঠিক করবে আমাদের বিবেকের স্থান কোথায়।
এই দিনটি যেন আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার দিন হয়—আমরা কী ন্যায়ের পক্ষে, নাকি নীরব সহমত দিয়ে অন্যায়ের প্রশ্রয় দিচ্ছি। ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে আজ আমাদের সবারই নিজ নিজ অবস্থান নির্ধারণ করার সময়।
দিগন্তকণ্ঠ মনে করে, সত্য বলার সাহস থাকা উচিত সকল গণমাধ্যমের। ফিলিস্তিন ইস্যু কোনো একক ধর্ম, গোষ্ঠী বা জাতির নয়—এটি মানবতার। নাকবা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাসের প্রতিটি নির্যাতনের দায় একদিন এসে দাঁড়ায় আমাদের নীতিবোধের সামনে। আমরা কাদের পক্ষে, তা নির্ধারিত হয় আমাদের নীরবতা বা প্রতিবাদের ভাষায়।
সত্য, স্বাধীনতা ও সাম্যের যে আদর্শে দিগন্তকণ্ঠ বিশ্বাস করে, সেই আদর্শ আমাদের বাধ্য করে নাকবার ইতিহাস জানাতে, স্মরণ করাতে এবং এর বিরুদ্ধে ন্যায়ভিত্তিক অবস্থান নিতে।
১৫ মে কেবল একটি তারিখ নয়—এটি একটি আর্তনাদ, এক দীর্ঘশ্বাস, এক অব্যক্ত ইতিহাস, যা আজও লেখা হচ্ছে রক্ত ও অশ্রু দিয়ে। এই দিনটি যেন আমাদের মননে জেগে তোলে প্রতিবাদের শক্তি, সত্যের পক্ষ অবলম্বনের সাহস এবং মানবিকতার প্রতি দায়বদ্ধতার নতুন শপথ।