২০০১ সালের ১৮ই এপ্রিল। সুবহে সাদিক তখন। একটু পরই সূর্য উঠবে পূর্বাকাশে। কৃষকেরা লাঙ্গল আর কাস্তে কোদাল হাতে দলে দলে রওনা হবে ফসলের ক্ষেতে। আর সেই ভোর ফোটার আগে, হালকা কুয়াশা ঢাকা মাঠের ভিতর দিয়ে কয়েকজন কৃষক তাদের ধানক্ষেতে যাচ্ছিলেন সেচ ব্যবস্থা দেখতে। অন্যান্য দিনের মতো এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক একটি কাজ। কিন্তু! আজকে হঠাৎই তারা থমকে দাঁড়ায়।
সীমান্তের খুব কাছে এই ছোট্ট গ্রামটির মানুষগুলোর দিন কাটে নির্মম বিএসএফের গুলির অনিশ্চয়তার মধ্যে। সুতরাং তাদের সবসময় কাটাতে হয় এক অতন্দ্র সতর্কতার মাঝে। কুয়াশা-জড়ানো ভোরের চাদর ছিন্ন করে তাঁরা দেখে একদল অস্পষ্ট অবয়বের সশস্ত্র সৈন্যদের। ধানক্ষেত মাড়িয়ে, নিঃশব্দে এগিয়ে চলছে সীমান্তের ভেতরে। কিন্তু তখনো কৃষকেরা বুঝে উঠতে পারেনি এরা কারা। এবার কিছু সৈন্য সামনে এগিয়ে এসে কড়া হিন্দি উচ্চারণে জানতে চায় “বিডিআর ক্যাম্প কোথায়?” এবার শিউরে ওঠেন কৃষকেরা। তারা বুঝতে পারেন, এরাই সেই নির্মম বিএসএফ—ভারতের এক নৃশংস সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
ভীতসন্ত্রস্ত কৃষকেরা দৌড়ে দেন বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পের দিকে। পথিমধ্যে খবর পৌঁছায় আনসার বাহিনীর সদস্য সাইফুল ইসলাম লালের কাছে। তিনিসহ সবাই তৎক্ষণাৎ বিডিআর ক্যাম্পে ছুটে যান। ক্যাম্পে তখন মাত্র আটজন বিডিআর সদস্য। সাইফুলের কথা শুনে সবাই প্রথমে আতঙ্কিত হলেও, দেশপ্রেমের অতন্দ্র প্রহরী বিডিআর জওয়ানরা বুক চিতিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজি—এই প্রতিজ্ঞায় অস্ত্র হাতে তুলে নেয় ৮ জন বিডিআর জওয়ান। সাথে যোগ দেন আনসার বাহিনীর সদস্য সাইফুল ইসলাম লাল। তাঁর এই অদম্য সাহস দেখে পিছপা হন না গ্রামবাসীরাও। “ওরে ও জগতবাসী ধরকষে লাঙ্গল” বলে ক্ষেতে চাষ করা কৃষকেরা এবার “ক্যাপ্টেন ভাই, আমরা পাশে আছি!” বলে ছুটে আসেন বাঁশের লাঠি, দা, কোদাল সহ যা পেয়েছেন হাতে নিয়ে। তারপরের কাহিনি যেন কোনো রুদ্ধশ্বাস সিনেমার চিত্রনাট্য। দেশপ্রেমের এই অদম্যতা যেন বদলে দেয় ইতিহাস, একদল ভারি অস্ত্রে সুসজ্জিত বাহিনীকে পদানত করে দেয় ৮ জন বিডিআর আর একদল গ্রামবাসী।
হানাদার বিএসএফের ভারী অস্ত্রের গুলিতে কেঁপে ওঠে পুরো সীমান্ত। তবে মাত্র আটজন সৈনিক আর একদল গ্রামবাসী প্রথম চার ঘণ্টা ঠেকিয়ে রাখেন শত শত বিএসএফকে। কোণঠাসা করে অভ্যন্তরে ঠেলে দেন। এরপরই যুক্ত হয় জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে আগত বাহিনী। এবার পুরোপুরি পাল্টে যায় দাবার ঘুঁটি। আক্রমণ করতে আসা বিএসএফ এবার নিজেরাই আটকা পড়ে ইঁদুর ধরার কলে!
চারদিকের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে বিএসএফ একসময় ১৬ জন সৈন্যকে বাংলাদেশের ভিতরে ফেলে পালিয়ে যায় কাপুরুষের মতো। তারা পরাজয় বরণ করে অদম্য একদল সৈন্যের কাছে। যদিও সরকারি হিসেবে বলা হয় ১৬ জন, তবে সেদিন উপস্থিত সবাই জানায় সেখানে আরও অনেক বিএসএফ হানাদারের লাশ পড়েছিল। পরে যা ফেরত দেওয়া হয়। তবে গ্রামবাসী বিএসএফের এই নির্মম আক্রমণের জবাব দেন আরও অভিনবভাবে—তারা একজন বিএসএফ সদস্যের মরদেহ বাঁশে ঝুলিয়ে কাঁধে করে নিয়ে যান। কারণ এই বিএসএফরা এই আক্রমণে মর্টার শেল ব্যবহার করে প্রায় ১৭৯টি বাড়ি গুড়িয়ে দেয়। সুতরাং তাদের এই ক্ষোভ স্বাভাবিক। আর এর কারণে ভারত সরকার দেশের ভিতর প্রবল চাপে পড়ে। প্রশ্ন ওঠে, টাকা দিয়ে পালা একদল কাপুরুষদের প্রতি। যদিও বাংলাদেশের নিকট ভারতের এই পরাজয় নতুন না। ইতিপূর্বে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্যরা তথা ইপিআর ভারতকে সমুচিত জবাব দিয়েছিল।
ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এই পরাজয় ছিল বিশাল একটি সফলতা ও জবাব। কারণ এই পরাজয়ের ধাক্কায় ভারত সরকার চাপে পড়ে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার এই বিজয়কে গৌরব হিসেবে না দেখে, অস্বস্তির বিষয় বলে পাশ কাটিয়ে যায়। এরপরই শুরু হয় বিডিআর দুর্বল করার পরিকল্পনা, যার পরিণতি আমরা ভয়াবহভাবে দেখেছি ২০০৯ সালের পিলখানা ট্র্যাজেডিতে।
তবে রৌমারীর ঘটনার পরই মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানকে বিডিআরের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনীতে ফেরত আনা হয়। যেখানে সীমান্তের এই বীরোচিত অবদানের জন্য তাঁর ও বাহিনীর রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার কথা ছিল, সেখানে তিনি পেলেন তিরস্কার! যদিও মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান এ ঘটনাকে ভুল বা দায় না এড়িয়ে সরাসরি বলেন—
“আপনারাই বিচার করুন। বর্ডারে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বেই আমাকে নিয়োজিত করা হয়েছে। আমি যদি ঐ সময়ে আপোষ করতাম, তাহলে এই সমালোচনা আমাকে শুনতে হতো না। আমার তো কাজই হলো সীমান্ত রক্ষা করা এবং সীমান্তের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া।”
এই ঘটনার পর শহীদ বিডিআর সদস্যদের স্মরণে নির্মিত হয় দায়সারা গোছের স্মৃতিস্তম্ভ। বীরোচিত এই বিজয়কে নানাভাবে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালানো হয়। যার অন্যতম নজির বিডিআর বিদ্রোহের নাটক করে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে দুর্বল করে দেওয়া। যার ফলশ্রুতিতে জীবন যায় অজস্র ফেলানীদের!
তবে এখন সময় বদলেছে। এই ইতিহাস এখন নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। পাঠ্যক্রমে বড়াইবাড়ির ঘটনাকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং একে একটি অদম্য জাতীয় সাহসিকতার উদাহরণ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার করা দরকার।
পাশাপাশি সীমান্তে জাতীয় নিরাপত্তা এবং মানুষের জীবন সুরক্ষায় সরকারের আরও দৃঢ় অবস্থান নেওয়া জরুরি। যাতে আর কখনো বিএসএফ সীমান্তের এক ইঞ্চি ভিতরে পা ফেলতে সাহস না পায়। প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, কিন্তু সেটি যেন আত্মমর্যাদাহীন, চুপচাপ অন্যায্যতা মেনে নেওয়া ‘মৌন প্রতিবেশী’ হয়ে না দাঁড়ায়। কূটনীতি হতে হবে সম্মানজনক, ভারসাম্যপূর্ণ। যেখানে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গঠিত হবে, সেবানুদাস হয়ে নয়!
বড়াইবাড়ির সেই রক্তাক্ত সকাল কেবলমাত্র একটি দিনের ইতিহাস নয়, এটি আমাদের এই ভূমির স্বাধীনতা, ভূখণ্ডের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ। তবে এখনো একটি প্রশ্ন বারবার মনে জাগে—আমরা কি আজও সীমান্তে নিরাপদ? এবং আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতি কতটা প্রস্তুত সেই নিরাপত্তা নিশ্চিতের জবাব দিতে?