হযরত উকবা ইবনে আমির (রা) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা)’ এরশাদ করেছেন যে, যদি আমার পরে কেউ নবী হতো, তবে তা হতেন ওমর। ইসলামে ‘ওমর (রা)’-এর অবস্থান কতটা সম্মানজনক, তা ‘রাসুল (সা)’-এর বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। তিনি ইসলামের মহান চার খলিফার ২য় খলিফা। তাঁর শাসনামলে ইসলামের বিজয়যাত্রা এতটাই বিস্তৃত হয়েছিল যে, তৎকালীন সময়ে মানুষ যতটুকু ভূমি আবিষ্কার করতে পেরেছিল, তার অর্ধেকই মুসলিমরা জয় করেছিল ওমর (রা)-এর শাসনামলে। এ কারণে তাঁকে বলা হয় অর্ধ জাহানের খলিফা। তিনি প্রথম ‘আমিরুল মুমিনিন’ উপাধি পান। কিন্তু এই ‘ওমর (রা)’-ই তাঁর জীবনের দীর্ঘ একটি সময় ছিলেন ইসলামের শত্রু।
ওমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ
‘রাসুল (সা)’-এর কাছে প্রথমদিকে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন গরিব, দাস-দাসী। এজন্যই তাদের সহজেই নির্যাতন করত মক্কার প্রভাবশালীরা। সেই নির্যাতন সহ্য করার মতো ছিল না। তবু তাঁরা ঈমানের ওপর ছিলেন অটল। ‘ওমর (রা)’-ও ছিলেন নির্যাতনকারীদের মধ্যে একজন।
এ রকম নির্যাতনে ব্যতীত হয়ে ‘রাসুল (সা)’ একপর্যায়ে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! ওমর ইবনে খাত্তাব অথবা আবু জাহেলের মধ্যে তোমার কাছে যে বেশি পছন্দনীয়, তাকে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দাও এবং তার দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি কর।’
এ দোয়া কবুল হয় অচিরেই।
একদিন ‘ওমর (রা)’ ‘রাসুল (সা)’-কে হত্যার উদ্দেশ্যে তলোয়ার নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন। পথের মধ্যে সাহাবি ‘নাইম বিন আবদুল্লাহ (রা)’-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। ‘নাইম (রা)’ ওমরের উদ্দেশ্য আঁচ করতে পেরে বলেন, ‘‘আগে নিজের ঘর সামলাও ওমর, আমি শুনেছি তোমার বোন, ভগ্নিপতি—এই দুজনেই ইসলাম গ্রহণ করেছে।’’
তার এই কথা শুনে ওমর যেন রেগে লাল হয়ে যান। তিনি তখনই তার পথ পরিবর্তন করেন এবং তার বোনের বাড়ির দিকে রওয়ানা দেন। ‘ওমর (রা)’ যখন সেখানে পৌঁছান, তখন তাঁর বোন ও ভগ্নিপতিকে কোরআন পড়ে শুনাচ্ছিলেন ‘খাব্বাব (রা)’। ওমরের উপস্থিতি টের পেয়ে ‘খাব্বাব (রা)’ লুকিয়ে পড়েন।
‘ওমর (রা)’ ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমরা কী পড়ছিলে?’’ একথা বলেই তিনি ভগ্নিপতিকে মারতে শুরু করলেন। তাঁকে রক্ষা করার জন্য বোন ফাতিমা এগিয়ে এলে ফাতিমাও আহত হন। এই পরিস্থিতিতে ওমরের বোন প্রচণ্ড জেদ চেপে বলে বসলেন, ‘‘হ্যাঁ, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। তুমি আজ আমাদের মেরে ফেললেও আমরা ইসলাম ত্যাগ করব না।’’
এমন জবাবে ‘ওমর (রা)’ কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়েন। কেননা, তাঁর বোন ও ভগ্নিপতি সবসময় তাঁকে সম্মান করে চলতেন। এমন অবস্থায় ‘ওমর (রা)’ কিছুটা শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আচ্ছা, তোমরা আমাকে বলো, তোমরা কী পড়ছিলে?’’
ওমরকে শান্ত দেখে বোন আরও সাহসী হয়ে উঠে বললেন, ‘‘এই বাণী পড়তে হলে তোমাকে অবশ্যই পবিত্র হতে হবে।’’ তখন ‘ওমর (রা)’ গোসল করে আসেন। এরপর তাঁর বোন সূরা লেখা কাগজটি তাঁর দিকে এগিয়ে দেন। সেখানে সূরা ত্বাহার কিছু অংশ লেখা ছিল। ‘ওমর (রা)’ সেই কাগজের লেখা পাঠ করেন। তখন তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করল।
তাঁর ভেতর এমন পরিবর্তন দেখে ‘খাব্বাব (রা)’ আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘‘ওমর, তোমার ব্যাপারে সেদিন আল্লাহর রাসুল দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেছেন।’’
তিনি ‘খাব্বাব (রা)’-এর কাছে ‘মুহাম্মদ (সা)’-এর অবস্থান জানতে চান এবং তিনি ‘মুহাম্মদ (সা)’-এর গৃহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
‘ওমর (রা)’ যখন ‘রাসুল (সা)’-এর দরজায় কড়া নাড়েন, তখন সাহাবিরা তলোয়ারসহ ‘ওমর (রা)’-কে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যান। তাঁরা ভাবতে থাকেন, ওমর যদি ‘রাসুল (সা)’-এর কোনো ক্ষতি করে!
তখন ‘রাসুল (সা)’-এর গৃহে উপস্থিত ছিলেন ‘হযরত হামজা (রা)’। তিনি বলেন,
‘‘খাত্তাবের পুত্রকে ঘরে আসতে দাও। যদি তার মনে কোনো খারাপ চিন্তা থেকে থাকে, তাহলে তার তলোয়ার দিয়েই আমি তাকে হত্যা করব।’’
এই কথা বলে তিনি নিজেই দরজা খুলে ওমরকে টেনে-হিঁচড়ে ঘরের ভিতরে নিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁদের এই ধারণা ভুল ছিল। ‘ওমর (রা)’ ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ ব্যক্ত করলে ‘হযরত হামজা (রা)’ তাঁকে ছেড়ে দেন। এরপর ‘রাসুল (সা)’ ‘ওমর (রা)’-এর কাছে এলেন এবং তাঁর পরিধানের পোশাক ও তলোয়ারের একাংশ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ‘‘হে আল্লাহ! ওমর ইবনে খাত্তাবের দ্বারা দ্বীনের শক্তি ও সম্মান দান কর।’’
এ কথা শুনে হযরত ‘ওমর (রা)’ ‘রাসুল (সা)’-এর হাত ধরে বললেন,
‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসুল।’’
‘ওমর (রা)’-এর কলেমা পাঠ শোনামাত্র ভেতরে উপস্থিত সাহাবিরা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে উঠলেন।