হুমাইয়া ছালছাবিল ফাইজা
[ছয়]
প্রায় আধঘন্টা হয়ে এলো মনির স্যার তসবীহ জপায় মত্ত ফকিরের সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলছেন। হুকুমের আবেশে নোমানকে নয় হাত দূরে থাকতে বলে দিয়েছেন, নোমানও বাধ্য ছাত্রের বেশে দাঁড়িয়ে আছে স্যারের বলে দেয়া দূরত্ব মেপে। মাঝে মাঝে কান উঁচিয়ে শোনার চেষ্টা করছে তাদের কথপোকথন। রাস্তায় বেপরোয়া ট্রাক-বাসের আনাগোনা, অসন্তুষ্ট মানুষের বিরক্ত মুখ, একাকীত্বের কোলাহলে দাঁড়িয়ে থাকা সরু সরু গাছের সারি, গাছগুলোর নাম কী?
অনেক চেষ্টা করেও নোমান খুঁজে বের করতে পারল না, তারপর নিজেই নাম দিতে লাগল। একটা সার্বজনীন নাম পছন্দ করল যা উপস্থিত সবগুলো গাছকে একই জাতের করতে পারে, জলজ পাতার গাছ। এই নাম দেয়ার কারণ আধো জোছনার ছাপ পড়ছে গাছের পাতার শরীরে।
—কী রে তারা গুনছিস?
মনির স্যার ফিরে এলেন গালভরা হাসি নিয়ে।
—জ্বী না স্যার, গাছের পাতার উপর জোছনা দেখছিলাম। কী কথা হলো ওনার সাথে? বলা যাবে?
—হুম যাবে। কিন্তু এখন না। বিশ মিনিট পার হলে বলা যাবে। কোনো তথ্য কিংবা আবেগ শোনার পর কিছুক্ষণের জন্য ব্রেইনকে সেটা প্রসেস করার সময় দিতে হয়।
—আচ্ছা স্যার। যেমনটা আপনি বলবেন। চলুন তাহলে হাঁটি।
কচ্ছপ জীবন আর দুই খরগোশ প্রাণ। পাশাপাশি ভিন্নধর্মী ঢঙে ফুটপাতের অজস্র পদচিহ্ন অতিক্রম করছে। নোমানের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন স্যার ফকিরের বলা কথাগুলো বলবেন। স্বপ্নের সবুজ প্রসারণ ঘটছে মসজিদের মাইকে আযানের আদলে।
—তা তুই আজকাল কী করছিস? পড়াশোনা করছিস বলে মনে হচ্ছে না।
ভেঙে ভেঙে, দীর্ঘ বিরতি দিয়ে স্যার বলছেন।
—ঠিকই ধরেছেন স্যার। পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছি। গানবাজনা নিয়েই পড়ে থাকি। ঈদে বড় একটা প্রোগ্রাম আছে, আপাতত সেটা নিয়ে ব্যস্ত।
—গানবাজনা! বাহ, তোর তো উন্নতি হয়েছে রে। তা পয়সা কড়ি কেমন পাস? দুবেলা ভাত জোটে?
—হুম জোটে। আসলে নেগেটিভ জিনিস তো, মানুষকে আবার নেগেটিভ জিনিস টানে বেশি। তাই তেমন খ্যাতি অর্জন না করলেও চালিয়ে নেয়া যায়।
—বেশ ভালো বলেছিস। এই নেগেটিভিটির চক্করে মানুষ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে, আর একারণেই আমি ভিক্ষুক হতে চাই। একেবারে খাঁটি ভিক্ষুক।
—আচ্ছা এখন কি সময় হয়েছে ওই ফকিরের বলা কথাগুলো শোনার?
—হুম হয়েছে। কিন্তু তুই ওসব শুনে কী করবি? তুই তো গানের মানুষ, গান নিয়েই থাক।
—খুব কৌতুহল হচ্ছে স্যার, আর আপনার এমন অদ্ভুত ইচ্ছার কারণটাও বোঝার তাগিদ পাচ্ছি।
সজোরে হাসছেন তিনি। হাসির ভাঁজে কেমন যেন দুঃখ নদীর জলছাপ। নোমানের কৌতুহলকে আরো বাড়িয়ে তিনি বলছেন,
—রোজ ঘুম ভেঙে উঠে সামাজিক প্রেক্ষাপটে জুতসই না হওয়ার বেদনায় জর্জরিত মানুষ আমি। কোথাও খাপ খাওয়াতে না পারার যে কষ্ট, সে কষ্ট তুই কাউকে বোঝাতে পারবি না রে। আমিও পারি না। তোর মনে আছে হাইস্কুল থাকতে আমি কত টাইমলি নামাজ পড়তাম, এক মিনিট ও দেরি করতাম না। এই যে দেরি করতে চাইতাম না, এটা নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার ভীষণ গালমন্দ করতেন। ওনার রোজকার গালমন্দ বেশ ছোঁয়াচে ছিল, পৌছে গেছিল অন্যান্য টিচারদের কাছেও। ধীরে ধীরে তারাও গালমন্দ করতে শুরু করল। এও শুনতে হলো, আমি ভালো মুসলিম সাজার ভান করি।
জানিস, কথাটা খুব গায়ে লাগছিল। খুব। ভাবলাম এবার থেকে ক্লাসের পরেই নামাজ পড়ব, একটু না হয় দেরি হলোই। কিন্তু তবুও খাপ খাওয়াতে পারি নি জানিস, শেষ অবদি 'শুক্রবারের মুসলমান' হয়ে গেলাম। অথচ জুতসই হওয়ার কপাল আমার হলো না। মাঝখান দিয়ে আল্লাহ্ তায়ালার সাথে যে যোগাযোগ আমার ছিল, তা ক্ষীণ হয়ে আসলো।
নোমান তাকিয়ে ছিল মনির স্যারের ছলছল চোখের দিকে, আর মনে করছিল নাম না জানা গাছগুলোর ওপর পড়া জোছনালোকের কথা। কোন সে নিবিড় ব্যথা তাদের ঘিরে রেখেছিল? নামহীনতার নাকি অশ্রুহীনতার। মনির স্যারও আজকাল কাঁদতে পারেন না, শুধু চোখ সজল হয়। বুক ফেটে ফোঁপানোর আওয়াজ তুলে কান্না আসে না।
[সমাপ্ত]