
মক্কা বিজয়: ক্ষমা, ন্যায় ও বিজয়ের এক মহাকাব্য
তালাল ফারহান
হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত লাভের পর তার নিজের জন্মভূমি মক্কার কুরাইশরা তার সবচেয়ে বড় বিরোধিতা করে। নবুয়ত লাভের মাত্র ১৩ বছর পর তিনি ইয়াসরিবে (বর্তমান মদিনা) হিজরত করতে বাধ্য হন। তবে হিজরতের পরও কুরাইশরা তাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ করেনি এবং একে একে বদর, ওহুদ ও খন্দক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়।
হুদাইবিয়ার সন্ধি ও চুক্তি ভঙ্গ
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে মদিনার মুসলিমদের সঙ্গে মক্কার কুরাইশদের ১০ বছরের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যেকোনো গোত্র মুসলিমদের বা কুরাইশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারত। বনু খোজাআ গোত্র মুসলিমদের পক্ষে এবং বনু বকর গোত্র কুরাইশদের পক্ষে চুক্তিবদ্ধ হয়। দীর্ঘদিনের শত্রুতার কারণে কুরাইশরা বনু বকর গোত্রকে উসকে দিয়ে বনু খোজাআ গোত্রের ওপর আক্রমণ চালায় এবং তাদের বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। কুরাইশরা ভেবেছিল, এই ষড়যন্ত্র তাদের বিরুদ্ধে যাবে না, কিন্তু সত্য প্রকাশ পেয়ে যায়।
খোজাআ গোত্রের এক প্রতিনিধি দল মদিনায় এসে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে বিচার চায়। রাসুল (সা.) তাদের প্রতিশোধ নেওয়ার আশ্বাস দেন এবং কুরাইশদের কাছে তিনটি শর্ত পাঠান:
১. বনু খোজাআ গোত্রের নিহতদের রক্তপণ দিতে হবে। ২. বনু বকর গোত্রের সঙ্গে কুরাইশদের মৈত্রী চুক্তি বাতিল করতে হবে। ৩. হুদাইবিয়ার সন্ধি বাতিল করতে হবে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
কুরাইশ নেতারা তৃতীয় শর্ত গ্রহণ করে, যার ফলে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন।
মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি
হজরত মুহাম্মদ (সা.) আনসার, মুহাজির এবং নব-মুসলিম গোত্রদের একত্রিত করে ১০,০০০ সৈন্য নিয়ে যাত্রা করেন। ৮ হিজরির ১০ রমজান, মুসলিম বাহিনী মার-উজ-জাহরান উপত্যকায় পৌঁছে। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান তখন যুদ্ধ এড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে পড়েন এবং নবী (সা.)-এর চাচা আব্বাস (রা.)-এর মাধ্যমে রাসুল (সা.)-এর শিবিরে আসেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মক্কার জনগণের জন্য নিরাপত্তা চান। রাসুল (সা.) ঘোষণা দেন:
- যারা অস্ত্র তুলবে না, তারা নিরাপদ।
- যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ।
- যারা নিজ নিজ ঘরে থাকবে, তারা নিরাপদ।
- যারা কাবায় আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ।
মক্কা বিজয়
১১ ডিসেম্বর ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে (১৮ রমজান ৮ হিজরি) মুসলিম বাহিনী চার ভাগে বিভক্ত হয়ে মক্কায় প্রবেশ করে।
- প্রথম সারির নেতৃত্ব দেন আবু উবাইদুল্লাহ ইবনে জাররাহ (রা.)।
- দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব দেন আল-যুবায়ের (রা.)।
- তৃতীয় সারির নেতৃত্ব দেন আলী (রা.)।
- চতুর্থ সারির নেতৃত্ব দেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)।
তিনটি বাহিনী রক্তপাতহীনভাবে প্রবেশ করে, কিন্তু খালিদের বাহিনীর সামনে কিছু কট্টর কুরাইশ যোদ্ধা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ১২ জন কুরাইশ নিহত এবং ২ জন মুসলিম শহীদ হন।
কাবা থেকে মূর্তি অপসারণ
মক্কায় প্রবেশের পর হজরত মুহাম্মদ (সা.) কাবা শরিফে প্রবেশ করেন এবং সেখানে থাকা ৩৬০টি মূর্তি ধ্বংস করেন। তিনি তখন কোরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত করেন:
“সত্য এসেছে, আর মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে; নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।” (সুরা আল-ইসরা: ৮১)
এরপর বেলাল (রা.) কাবার ছাদে উঠে প্রথমবারের মতো আজান দেন।
সাধারণ ক্ষমা ও ন্যায়বিচার
মক্কার জনগণ কাবার সামনে সমবেত হলে রাসুল (সা.) বলেন:
“হে কুরাইশগণ, তোমাদের প্রতি আমার কী আচরণ করা উচিত বলে মনে করো?”
তারা বলল,
“করুণা, হে আল্লাহর নবী। আমরা আপনার কাছ থেকে ভালো ছাড়া কিছুই আশা করি না।”
রাসুল (সা.) বললেন,
“আমি তোমাদের ঠিক তাই বলবো যা নবী ইউসুফ (আ.) তার ভাইদেরকে বলেছিলেন। আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই; তোমরা মুক্ত।”
তিনি সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তবে যুদ্ধপরাধী হিসেবে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, কিন্তু তাদের মধ্য থেকে ৬ জনকে হত্যা করা হয় এবং বাকিদের ক্ষমা করা হয়। যারা ক্ষমা চেয়ে ইসলাম গ্রহণ করে, তাদেরও মুক্তি দেওয়া হয়।
এভাবে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমার এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি চাইলে প্রতিশোধ নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে ইসলামের উদারতা ও মানবতার শ্রেষ্ঠ আদর্শ স্থাপন করেন।