একুশের প্রেরণা: বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের শপথ

একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক অর্জন ও বিপ্লবের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। তবে এটি শুধু একমাত্র ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলন ছিল না, বরং এটি ছিল পাকিস্তানি স্বৈরাচার গোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আইন ও নীতির বিরুদ্ধে প্রথম সফল প্রতিরোধ। যার মূল লক্ষ্য ছিল বাংলায় একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন। এবং এটিই বাঙালি জাতির শোষণমুক্ত,সাম্যভিত্তিক রাষ্ট প্রতিষ্ঠার প্রথম ভিত্তিপ্রস্তরও বটে। ১৯৫২ সালের এই দিনেই ভাষাসৈনিকদের আত্মাহুতি ও ইতিহাসের অনবদ্য ত্যাগের মাধ্যমে তারা আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার নিশ্চিত করেছিল । তাদের আত্মত্যাগ একদিকে যেমন বাঙালির ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, অন্যদিকে তেমনি বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট গঠনের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এবং এটি পরবর্তী সময়ে বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আজকের বাংলাদেশে বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট গঠনের জন্য একুশের চেতনাকে নতুনভাবে ধারণ করে সকল নাগরিকের রাষ্ট্রীও নিরাপত্তা ও যথাযথ অধিকার নিশ্চিত ও ধনী-গরিবের ব্যবধান কমানো, গ্রামীণ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া, দুর্নীতি প্রতিরোধ, আইন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা ও সবার জন্য রাজনৈতিক,সামাজিক,ধর্মীয় সহ সমান সুযোগ সৃষ্টি করা এই চেতনার বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে পারলে আমাদের আলোকিত ২১ ফেব্রুয়ারি সফলতার পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ করবে। আমাদের ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল ভাষা আন্দোলনের একুশ যেমন আবেগের, তেমনি সংগ্রাম ও দ্রোহের। একুশের পথ বেয়েই বাঙালি বারবার অন্যায়, অবিচার আর শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার সূর্যকে। হার না মানা দৃঢ়তায় অশুভকে রুখে দেয়ার প্রেরণা আমরা তরুণ প্রজন্ম একুশ থেকেই পাই। মুলত ৫২র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছিল স্বৈরশাসকের প্রভাব,আধিপত্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। তৎকালীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় পূর্ববাংলার মানুষের প্রতি অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা ছিল একটি সুপরিকল্পিত স্বৈরাচারী মনোভাবের দমন নীতি। এ অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে আমাদের ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের প্রতি নিজেদের দাবি উত্থাপন করে ।

ঐতিহাসিকভাবে একুশের চেতনা কেবল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সার্বিকভাবে একটি শোষণমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের শিক্ষা দেয়। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েই গেছে। ধনী-গরিবের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে, সামাজিক,অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য সমানভাবে সাম্য অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, এবং সমাজে নারীর অধিকার ও সংখ্যালঘু ও ধর্ম পালনে বিশ্বাসীদের নিরাপত্তা এখনও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা হলো বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রের বৈষম্যর উপস্থিতি  যা এখনো নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। আর যা হতে পারে ৫২,৭১ ও ২৪ এর স্প্রিট কে ধারণ করে। তবে একুশের চেতনাকে বাস্তবায়নের জন্য আমাদের নতুন প্রজন্মকে আরও বেশি সামাজিক সচেতন হতে হবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে বারবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে তা বাস্তবতার রূপরেখা দিতে হবে।১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা পথে শুরু হওয়া এই যাত্রাই পরবর্তীকালে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৪-এর স্বৈরাচার বিরোধী  গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও পূর্ণতা পেয়েছে তবে এই পূর্ণতা টেকশই করার দায়িত্ব আমাদের তারুণ্যের। প্রতিটি সংগ্রামে ছাত্ররা শুধু অংশগ্রহণই করেনি বরং নেতৃত্ব দিয়েছে-প্রাণ দিয়ে রচনা করেছে বিজয়ের অমর ইতিহাস। এ ধারাবাহিকতাই প্রমাণ করে, বাঙালির সফলতার লড়াই ও গণতন্ত্রের চেতনার মূলে রয়েছে ছাত্রদের সেই অদম্য শক্তি, যা আজও প্রজ্বলিত।১৯৫২-এ ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল মাতৃভাষার জন্য, ২০২৪-এ তারা লড়েছে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। এ সময়ে আমাদের কর্তব্য হলো ইতিহাসের সেই শিক্ষাকে জাগ্রত রাখা। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ই বলে-ছাত্ররা যখন জেগে ওঠে, তখন সব অন্যায়কে ভেঙে চুরমার করে। ১৯৫২ থেকে ২০২৪-প্রতিটি আন্দোলনেই ছাত্ররা রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তাদের কলম ও মিছিলের শক্তি ভেঙেছে স্বৈরাচারের লৌহ কপাট। ২০২৪-এর অভ্যুত্থান শুধু শেখ হাসিনার পতনই নয়, এটি ছিল ১৯৫২-এর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোরই প্রতিধ্বনি।ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। কিন্তু বাঙালি সেই ইতিহাস রচনা করেছে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। সেদিন ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের রক্তে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল, তা শুধু একটি ভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্মদাতা, স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার প্রেরণা,রক্তরাঙা অমর একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তের প্লাবনের মধ্য দিয়ে আজ সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবময় আসনে আসীন। শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের মতো বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি।শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের মতো বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’।তাই একুশের চেতনা হলো বৈষম্যহীন, শোষণহীন একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু স্মরণের দিন নয়, বরং এটি আমাদের জন্য শিক্ষার ও প্রতিজ্ঞার দিন। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগকে যথাযথ মর্যাদা দিতে হলে আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের শপথ নিতে হবে।একুশের চেতনা হোক আমাদের প্রতিদিনের পথচলার অনুপ্রেরণা, যেন আমরা সত্যিকার অর্থে একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। আর সেটা সমাজ বিনির্মাণের শপথ। … বৈষম্যহীন সমাজের কথা, প্রেরণা জুগিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহসে।একুশের চেতনা হোক আমাদের প্রতিদিনের পথচলার অনুপ্রেরণা, যেন আমরা সত্যিকার অর্থে একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক,সমতাভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ  রাষ্ট গড়ে তুলতে পারি। অতএব যে কোনো স্বৈরাচারের অন্যায়, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং ন্যায়ের পক্ষে সমন্বিত প্রতিবাদের প্রেরণা হোক একুশে ফেব্রুয়ারি।

নিউজটি শেয়ার করুন