[১]
ইফতারের আর এক-দেড় ঘন্টা মতো বাকি, আজ এত গরম পড়ছে তা বলার মতো না। মাহবুবের কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। যদিও দুহাতেই দু'টো বাজারের থলে থাকায় ঘামগুলো মুছতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল, তবুও নিজের কাঁধের সাহায্যে কোনোরকমে ঘাম মুছে ফেলল মাহবুব। মোজাম্মেল চাচার দোকানের সামনে প্রায় এক ঘন্টা যাবৎ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। একেই এত দীর্ঘ অপেক্ষা তার ওপর জুটেছে অসহনীয় গরম। মাহবুবের অবস্থা দেখে পাশের দোকানের রিপন চাচা বলে উঠলেন- বাজান, আর কতক্ষণ এমনে খাড়াইয়া থাকবা? আজ নাহয় চইলা যাও, কাইল আইসা নিও। এত ব্যস্ত হওনের কী আছে?
দ্বিতীয়বারের মত কাঁধে ঘাম মুছে রিপন চাচার দিকে তাকালো মাহবুব। কাঁধের অংশটুকু ঘামে ভিজে জবজব করছে একদম। ক্লান্তি মাখা বদন নিয়েই সামান্য হেসে জবাব দিলো সে।
-না চাচাজান, আজকেই নিয়া যাবো ইনশাআল্লাহ। আব্বায় মুখ ফুইটা চাইছে, খালি হাতে কেমনে যাই কন?
-কপাল কইরা একখান পোলা পাইছে মহসিন। আর আমাদের কপালডা দেহো! ছেলের হাতের খাবার তো দূর, হের লাথি ঝ্যাঁটা খাইয়াই কূল কিনারা পাইনা! মাহবুবের দিকে তাকিয়ে অতৃপ্তিতে ভরপুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রিপন চাচা।
[২]
দু'হাতের থলে এক হাতে নিয়ে দরজার কড়া নাড়তে লাগল মহসিন আলী। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার হুড়কো টেনে খুলে দিলো ফেরদৌসী বেগম। আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে স্বামীর হাত থেকে থলে দুটো নিজের হাতে নিলো সে। ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো মহসিন। ঘরের দাওয়াও বসে গামছা দিয়ে শরীরের ঘাম মুছে নিলো তৎক্ষনাৎ।
-ফেরদৌসী, একটু পানি দেও তো। তেষ্টায় গলা-বুক ফাইট্টা যাইতাছে গো।
-খাড়ান পানি লই আইতাছি।
মাটির কলসিটা একটু বাঁকা করে কোমরে সাথে নিয়ে পুকুর পাড়ের দিকে দ্রুত হাঁটা ধরলো ফেরদৌসী। এদিকে আব্বার কণ্ঠস্বর পেয়ে ঘরের ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে ছোট্ট মাহবুব বেরিয়ে এলো। কৌতুহলী চোখ দু'টো বারবার আব্বার দু'হাতের দিকে চেয়ে কিছুর সন্ধান করছিল। মহসিন আলী ছেলের উত্তেজনা দেখে হেসে উঠল। ছেলেকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো।
-‘কী হইছে আব্বাজান? কিছু খুঁজতাছো?'
আব্বার কথার জবাব না দিয়ে তখনও সে অনুসন্ধান কার্য চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ছেলের কান্ড দেখে মহসিন আলী হেসেই চলেছে।
-‘আব্বাজান, তুমি এমন ছটফট কইরো না। মোজ্জেম মিয়া এখনও দোকানে আসেনাই। একটু পর আবার যামু, তুমি মন খারাপ কইরো না। আজকে তোমারে মোজ্জেম মিয়ার হাতের গরম গরম মিষ্টি খাওয়ামুই, ইনশাআল্লাহ।
আব্বার খালি হাতে ফেরার কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য মাহবুবের মুখ শুকিয়ে গেলেও তাঁর দেওয়া আশ্বাসে আবারও খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ছেলেটা। শিশুদের মন ভোলানো যে কত সোজা!
পুকুর থেকে পানি এনে মহসিনকে এক গ্লাস পানি তুলে দিয়েই দ্রুত হাতপাখা এনে বাতাস করতে লাগলো ফেরদৌসী। কিন্তু মহসিন বেশিক্ষণ বসলো না। পানি পান শেষ করেই আবারও বেরিয়ে গেল মানুষটা।
“পোলার লাইগ্যা কত খাটবেন লোকটা, আল্লাহ-ই জানেন।” দরজার দিকে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড়িয়ে বলল সে।
দরজার হুড়কো টেনে দিয়ে আবারও রান্নার কাজে মন দিলো ফেরদৌসী। কচুশাকগুলো এখনও কাটা-বাছা হয়নি। দ্রুত হাত চালাতে হবে।
.
.
মাগরিবের পর,
দরজার কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে জায়নামাজ তুলে রেখে দরজা খুলতে গেলো ফেরদৌসী। ঘুনে ধরা হুড়কোটা যতবারই খুলে ততবরাই এক মুঠো ঘুন বেরিয়ে পড়ে ভেতর থেকে।
-আইছেন!
-হ
কেমন মনমরা হয়ে জবাব দিলো মহসিন। ফেরদৌসী ব্যাপারটা ঠিকই ঠাওর করলো। ধিরপায়ে গিয়ে দাওয়ায় মহসিনের পাশে বসলো সে।
-‘মন খারাপ কইরেন না। আজ হয়নি তো কী হইছে? অন্যদিন অর স্বাদ পূরণ কইরেন।'
-‘না , আমি আরও একবার যামু। পোলাডা মুখ ফুইটা চাইলো আর আমি জোগাড় করমুনা? না , এইটা হইবো না। নামাজ পর আবার যামু। মোজ্জেম মিয়া শ্বশুরবাড়ি থেইকা ফিরলে না-কি দোকান খুলবে বলছিলো রতন ভাই। তার যে আজ দেখা-ই পাইলাম না! তয় অন্য দোকানে যামু এবার।'
তখনও বৈদ্যুতিক বাতির আলো মহসিনদের বাড়ির নাগাল পায়নি। তবে শশী চিরকালই বদান্যতা দেখিয়েছে। তাঁর স্নিগ্ধ আলোতে ফেরদৌসী তখন লক্ষ করলো, মহসিনের চোখের কোণে জমা অশ্রুটুকু চিকচিক করছে।
[৩]
“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার।”
আযানের মধুর ধ্বনি ভেসে আসছে দক্ষিণ পাড়া জামে মসজিদ থেকে। পাখিগুলোও নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু মাহবুব তখনও মোজাম্মেল মিয়ার দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
“ইফতারের সময় হইয়া গেল!” আপন মনে বলল মাহবুব। কাছে ইফতার করার
মতোও কিছু নেই তার।
মাহবুবের শুকনা মুখ দেখে রিপন মিয়ার খারাপ লাগল। খানিকটা জোর করেই তাকে নিজের দোকানে নিয়ে গিয়ে দু'টো খেজুর আর পানি দিলেন খেতে। খেজুর-পানি দিয়ে ইফতার করে রিপন চাচার সাথে নামাজে গেল মাহবুব।
সারাদিনের কয়লা পোড়া রোদের পর মাগরিবের ওয়াক্ত থেকে চারপাশটা বেশ ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। আগমন ঘটলো উষ্ণতাহীন সমীরণের। প্রশান্তিদায়ক সে সমীরণ নিজের সাথে উড়িয়ে নিয়ে গেল শরীরের সবটুকু ক্লান্তি। মাহবুবের চুলের গোঁড়ায় গোঁড়ায় জমে থাকা ঘামগুলো বেশ খানিকটা শুকিয়ে গেল তার ছোঁয়ায়। দু'হাত পেতে তখন কায়মনোবাক্যে রবের দরবারে সে ফরিয়াদ করছে, “হে আমার প্রতিপালক! আমার পিতা-মাতার প্রতি দয়া করো, যেমন তাঁরা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।”[১]
নামাজ শেষ করে বসে তসবিহ পাঠ করছিল মাহবুব, ঠিক তখনই রিপন চাচা হন্তদন্ত হয়ে দোকানের বাইরে থেকে হাঁক ছাড়লেন।
“মাহবুব রে, তাড়াতাড়ি আয়, মোজাম্মেল আইছে।"
ডানপাশে রাখা থলে দু'টো হাতে নিয়ে দ্রুত দোকানের বাইরে চলে গেল মাহবুব। মোজাম্মেল মিয়ার দোকানে ঢুকতেই সে হতবাক হয়ে গেল! যে মিষ্টির জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল সে, ওগুলোই কড়াই থেকে গরম গরম ভেজে তুলছিল মোজাম্মেল মিয়া।
-“আলহামদুলিল্লাহ! চাচাজান, আপনি আইলেন শেষমেশ!"
বড় হাতায় করে কড়াই থেকে মিষ্টি ছেঁকে তুলতে তুলতে মোজাম্মেল মিয়া বলল- “হ-রে বাপ আইছি। আর আইসা শুনলাম তুই নাকি এতক্ষণ আমার লাইগা খাড়াই ছিলি! আহারে, আজকাই আসতে দেরি হইলো আমার। এইযে মিষ্টিগুলা করতাছি এগুলা আগে কইরা তারপর অন্য মিষ্টি বানামু। ইশ! রিপন ভাই যদি আর একটু আগে আইসা কইতো তাইলে এগুলাতে হাত দিতামনা। তুই আরেকটু খাড়াবি বাপ?"
‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি' কথাটা মাহবুবের এখন বলতে খুব ইচ্ছে হলো কিন্তু দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে তাই অত কথা না বাড়িয়েই সে বলল- “না চাচা খাড়ান লাগবোনা আর। যে মিষ্টি করছেন আব্বা ঐ মিষ্টিই খায়তে চায়। আপনি তাড়াতাড়ি দেন। আমি নিয়া যাই, আব্বা আমার জন্য অপেক্ষা করতাছে। "
*
ঠক ঠক করে দরজায় কড়া নাড়ল মাহবুব। জং ধরা কড়াগুলো এখন আগের মতো আর জোরালো আওয়াজ করতে পারেনা। কেমন অদ্ভুত শব্দ হয় ওগুলো থেকে। কড়া নাড়লেই ঘুণে ধরা কপাটের কাঠের গুড়ো পড়তে শুরু করে। ব্যবসাটা আরেকটু দাড়ালেই ঘরটা মেরামত করবে ভেবেছে। আর আব্বার অনুমতি পেলে মেঝেটাও পাকা করার নিয়ত করেছে মাহবুব। দাদার দেওয়া ঘরতো, বাপ-ছেলের আবেগ কাজ করে খুব ঘরের প্রতিটা কোণের প্রতি, বেড়ার প্রতিটা বাতার(টিনের ঘরের কাঠের পাশি-কে বাতা বলে) প্রতি যেন মায়া কাজ করে। তা যতই ভঙ্গুর হোক, কাজ তো চলে যাচ্ছে দিব্যি।
কিছুক্ষণ পর হুড়মুড় করে হুড়কো পড়ার আওয়াজ এলো ভেতর থেকে। হন্তদন্ত হয়ে দরজা ঠেলে দ্রুত ভেতরে ঢুকেই মাহবুব দেখলো হুড়কোটা মায়ের একদম পায়ের কাছেই পড়েছে । আরেকটু এগিয়ে দাঁড়ালেই হয়তো বৃদ্ধহাড়গুলো থেঁতলে যেত।
-মা! পায়ে লাগছে না-কি?
-না-রে বাপ, লাগেনাই। দূরেই পড়ছে হুড়কা খান।
-সাবধানে থাকবা না তুমি!
তড়িঘড়ি করে থলেগুলো দাওয়ায় রেখে মায়ের পায়ে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো মাহবুব। মা-বাবার ‘উহ!' শব্দটাও ওর হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। গ্রামের আর পাঁচটা বাপ-মায়েরা মহসিন-ফেরদৌসীকে এ বিষয়ে বেশ হিংসে করে। ছেলের এমন যত্ন আজকাল ক'জনের ভাগ্যেই বা জোটে!
-ও বাপ তুই আমারে ছাড়, আমার কিচ্ছু হয়নাই। তয় তুই এত দেরি করলি কেন বাপ? সারাদিন পর খাইট্টা-খুইট্টা বাড়ি ফিরলি পরে আবার বাইর হইলি, ইফতারডাও তো করলি না। কই ছিলি বাপ?
-মা, আমি মোজাম্মেল চাচার দোকানে গেছিলাম মিষ্টি আনতে। আব্বায় না গরম গরম মিষ্টি খাইতে চাইলো কালকা। চাচা দোকানে ছিলোনা, তাই খাড়াই ছিলাম।
-সারাডা দিন রোজা আছিলি, ইফতার করছস বাপ আমার?
-হ মা, রিপন চাচার লগে ইফতার করছি। এহন মোজাম্মেল চাচা আসলো, গরম গরম মিষ্টি বানায়তেই তা নিয়া আইলাম। আব্বারে ডাকো তুমি।
ছেলের কান্ড দেখে ফেরদৌসীর চোখের কোণে অশ্রুরা জমাট বাঁধলো। অবশ্য তা গড়িয়ে পড়ার আগেই শাড়ির আঁচলের এক কোণা দিয়ে মুছে ফেলল সে।
“শুনছেন! আপনের আব্বাজান আপনের লাইগা মিষ্টি আনছে। তাড়াতাড়ি আসেন।"
ঘরের ভেতর থেকে লাঠিতে ভর করে মহসিন বেরিয়ে এলো। মিষ্টির থলেটা বাবার হাতে তুলে দিয়ে মাহবুব বলল- “আব্বা, দেহেন আপনার জন্য গরম গরম মিষ্টি আনছি। নেন খান আব্বা। ”
মহসিন দ্রুত থলেটা ধরে ছোট্ট শিশুর মতো একটা হাসি দিলো৷ যদিও প্রায় অর্ধপাটি দাঁত নেই তবুও বেশ সুন্দর সে হাসিটা। আব্বার হাসি দেখলেই মাহবুবের হৃদয় উদ্যানে প্রশান্তির কল্লোল বয়। মহসিন বসে বসে মিষ্টি খাচ্ছে, ছোট্ট মাহবুব যেভাবে খেতো ঠিক সেভাবে। এ যেনো সময়ের পরিক্রমায় দায়িত্ব আর অবস্থানের রথ-বদল। ছোট্ট এ জীবনে এরচে অভিরাম কোনো দৃশ্য মাহবুবকে এতটা সুখ দেয় না। বাপের চোখের এই উল্লাস মায়ের মুখের এই উচ্ছ্বাস যেনো মাহবুবের কাছে সোনার কাঠি, রূপোর কাঠি। এগুলো তার কাছে রব্বের দেওয়া জান্নাতী নেয়ামত, যার এক টুকরো দুনিয়াতেই পাওয়ার নসিব হয়েছে মাহবুবের আলহামদুলিল্লাহ।
[১]রেফারেন্সঃ সূরা ইসরাইলঃ২৪