বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে ঢাকা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়। আগে যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী এবং কিছু রাজনৈতিক ভাষ্য ছাড়া বাংলাদেশ নিয়ে তেমন কোনো সংবাদ স্থান পেত না সেখানে ৫ আগস্টের ঘটনার পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে শত শত প্রতিবেদন করতে থাকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। তবে সে সব প্রতিবেদনের ধরন নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা কেমন তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস উইংয়ের প্রধান ফয়সাল মাহমুদ। সোমবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করা এক পোস্টে গত দুই মাসে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর করা প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন তিনি।
ফয়সাল মাহমুদ লিখেছেন, ভারতীয় গণমাধ্যম, বিশেষ করে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো কখনো বাংলাদেশের প্রতি জোরালো আগ্রহ দেখায়নি। শুধু দ্বিপাক্ষিক সফর, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী বা মাঝে মাঝে রাজনৈতিক ভাষ্যের প্রতিবেদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অল্প কয়েকটি বিশেষায়িত ভারতীয় প্রকাশনা মাঝে মাঝে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো কভার করত।
তবে, ৫ আগস্টের ঘটনার পর দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। একটি বিশাল গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন কেবল সাউথ ব্লককেই নয়, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকেও অপরিচিত অঞ্চলে ঠেলে দিয়েছে।
প্রথম দিকে, বেশ কয়েকটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নিপীড়নের’ প্রতিবেদন ফলাও করে প্রচার করতে থাকে। যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ভুল বা মিথ্যা তথ্য এবং যাচাই না করা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট বা টুইটের উপর ভিত্তি করে। এর বাইরে মূলধারার ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো যে মতামত এবং বিশ্লেষণগুলো প্রচার করতে থাকে তার অধিকাংশই ছিল বিদ্বেষপূর্ণ।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশকে একটি ‘শত্রু রাষ্ট্র’ এবং একইসঙ্গে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে চিত্রিত করতে থাকে। তারা দেখানোর চেষ্টা করে যে, বাংলাদেশ ইসলামপন্থিদের দখলে চলে গেছে এবং এখানে কোনো আইন-কানুন কাজ করছে না।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এবং এর প্রেস উইং থেকে ভারতীয় সাংবাদিকদের ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং সরাসরি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশের অনুরোধ করা হয়। কিন্তু খুব কম সংখ্যক সংবাদমাধ্যমই সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। গুজব এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমচালিত বিষয়বস্তু দ্বারা পরিচালিত সংবাদ চক্র মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য টেকসই নয়। ফলস্বরূপ, নভেম্বরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশের সংবাদ ধীরে ধীরে প্রথম পৃষ্ঠা এবং প্রাইম টাইম স্লট থেকে হারিয়ে যেতে থাকে।
ডিসেম্বর থেকে, আমি ব্যক্তিগতভাবে ভারতীয় মূলধারার প্রিন্ট এবং অনলাইন মিডিয়াতে বাংলাদেশের সংবাদ পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি প্রতিবেদনগুলোর তালিকা করেছি এবং ভারতীয় মিডিয়াতে বাংলাদেশ বিষয়ক সংবাদের প্রকৃতি নিরূপণ করতে সক্ষম হয়েছি। এখানে টেলিভিশন বা ইউটিউব চ্যানেলগুলোর পর্যবেক্ষণ নেই, শুধু সংবাদপত্রগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে এ ফলাফল তুলে ধরছি-
#ডিসেম্বর ফলাফল#
ডিসেম্বরে, ভারতের ৯টি মূলধারার জাতীয় ইংরেজি সংবাদপত্র এবং ছয়টি অনলাইন পোর্টাল বাংলাদেশ সম্পর্কে মোট ১৭৩টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনগুলো ছিল মূলত- দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর আপডেট, পাকিস্তান ও চীনের সাথে সম্পর্ক, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ক্রমবর্ধমান আইনশৃঙ্খলা এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন সম্পর্কিত।
যদিও ডিসেম্বরে এসব সংবাদপত্রে যে পরিমাণ বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রতিবেদন পাব বলে আমি প্রত্যাশা করেছিলাম প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবেদন ছিল তার চেয়ে কম। যে ১৭৩টি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৬০%-এরও বেশি প্রতিবেদন ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘শত্রুতাপূর্ণ’ সুর।
#জানুয়ারি ফলাফল #
জানুয়ারিতে, ভারতের ৯টি মূলধারার ইংরেজি সংবাদপত্র এবং ছয়টি অনলাইন পোর্টাল বাংলাদেশ সম্পর্কে মোট ১৩৬টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার বেশিরভাগই ডিসেম্বরে প্রকাশিত সংবাদের মতো একই বিষয়বস্তু নিয়ে। তবে, সংখ্যালঘু নির্যাতন সম্পর্কিত প্রতিবেদন এই সময়ে কম ছিল।
এই সময়ে ভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে বাংলাদেশ নিয়ে কঠোর সুর কিছুটা কমেছে। আগের ৬০% থেকে কমে প্রায় ৪৫% হয়েছে। উল্লেখ্য, ‘কঠোর বা শত্রুতাপূর্ণ সুর’ সম্পর্কে আমার সংজ্ঞা আমার ব্যক্তিগত বিচারের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে নয়।
পোস্টে ফয়সাল মাহমুদ আরও লেখেন, নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস উইংয়ের প্রধান হিসেবে, আমার একটি দায়িত্ব হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি অফিসে মিডিয়া পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন পাঠানো। আমি আমার ফেসবুক পেজে নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় মিডিয়া কভারেজের আপডেট শেয়ার করে যাব।