গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি বন্দিদের মধ্যে চারজন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় তাদের চিকিৎসা চলছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।
শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অনেকেই চরম শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছেন। দীর্ঘ কারাবাসে অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এর আগে ইসরায়েলি কারাগার থেকে ৩৬৯ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর বিনিময়ে গাজায় হামাসের হাতে থাকা তিনজন ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি পেয়েছেন। গত মাসে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় এই বন্দি বিনিময় সম্পন্ন হয়।
চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল ও হামাস কয়েক দফায় বন্দি ও জিম্মি বিনিময় করেছে। তবে মুক্তি পাওয়া ইসরায়েলি জিম্মিদের সুস্থ-সবল দেখা গেলেও ফিলিস্তিনি বন্দিদের অনেককেই চরম দুর্বল অবস্থায় দেখা গেছে। কারও কারও শারীরিক অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল, তারা স্বাভাবিকভাবে হাঁটতেও পারছিলেন না।
ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি বন্দি আমির আবু রাদাহ আল জাজিরাকে জানান, তিনি ১৮ মাস ধরে নাফহা ডেজার্ট কারাগারে বন্দি ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাদের পানি ও বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল।
তিনি বলেন, আমাদের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রাখা হয়েছিল। দেড় বছর ধরে আমরা বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারিনি। আমাদের কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল।
সাম্প্রতিক বিনিময়ের আওতায় মুক্ত হওয়া আরেকজন ফিলিস্তিনি হাজেম রাজাব বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী তাকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আটক করে। এরপর থেকে তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়।
তিনি বলেন, ইসরায়েলিরা আমাদের বলেছিল— ‘নরকে স্বাগতম’। সত্যি বলতে, সেটি ছিল এক ভয়াবহ নরক। তিনি আরও জানান, প্রথম দিন থেকেই আমাদের ওপর প্রচণ্ড মারধর শুরু হয়। সেই নির্যাতন ছিল নৃশংস, কঠিন এবং অসহনীয়। বন্দিদের ওপর নির্যাতন শুধু কারাগারে থাকাকালীনই হয়নি, বরং মুক্তির আগের কয়েক ঘণ্টা আগেও তাদের মারধর করা হয়েছে বলে জানান ফিলিস্তিনি বন্দিরা।
আল জাজিরার সাংবাদিক নউর ওদেহ বলেন, ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্ত হওয়া ফিলিস্তিনিদের শারীরিক অবস্থা ছিল চরম শোচনীয়। তারা বলেছেন, ১৫ মাস ধরে অনাহার, অপুষ্টি এবং কঠোর পরিবেশের মধ্যে কাটিয়েছেন। এমনকি তাদের ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার সামগ্রী পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তারা ১০ দিনে মাত্র একবার গোসল করার অনুমতি পেতেন।
ফিলিস্তিনি বন্দিদের অভিযোগ, কারাগারে তাদের সঙ্গে যুদ্ধবন্দীর মতো আচরণ করা হয়নি বরং পরিকল্পিতভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। কারাগারে থাকাকালীন তাদের খাবারের পরিমাণ ছিল সীমিত, চিকিৎসাসেবা ছিল অপ্রতুল, এবং মারধর-নির্যাতন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
বন্দীদের মুক্তির পর তাদের শারীরিক অবস্থার করুণ চিত্র সামনে আসায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বলছে, ইসরায়েলি কারাগারগুলোতে বন্দীদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করা উচিত।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ইসরায়েলি কারাগারে বন্দীদের ওপর যে আচরণ করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের শামিল।
ফিলিস্তিনের নেতারা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ইসরায়েলি কারাগারগুলোতে এখনো হাজারো ফিলিস্তিনি বন্দী রয়েছেন, যাদের জীবন চরম ঝুঁকির মধ্যে আছে।
এই চারজন গুরুতর অসুস্থ বন্দীর শারীরিক অবস্থা কেমন হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকরা। তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে এবং যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে রামাল্লার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।