ইসলামো-ফিলিয়া – পর্ব দুই

ইসলামো-ফিলিয়া

হুমাইয়া ছালছাবিল ফাইজা

[দুই]

—বাসায় কুরআন শরীফ রেখে কী হবে বল, আমি তো আর পড়ব না কখনো। বেকার বেকার জায়গা নষ্ট তার চেয়ে একটা গল্পের বই থাকলে মন খারাপের দিনে পড়া যাবে।

মৃণাল বলল হাই তুলে ঘুম ঘুম ভাব কাটানোর চেষ্টা করে।

—কীসব বলিস, গানবাজনা করিস দেখে ঘরে কুরআন রাখবি না?

নিখুঁত উৎকন্ঠায় বলে উঠলো নোমান।

—গানবাজনার জন্য না। আসলে পড়া হবে না। তাই রাখি না।

—এটা ঠিক কাজ করেছিস? যতই না পড়ি, আমরা তো মুসলিম ঘরের সন্তান নাকি!

—দেখ আমি নিজের কাছে সৎ থাকতে চাই। আমার মনে হয় মানুষ হিসেবে এটাই আসল ধর্ম। আমি গানের মানুষ, তাই স্বাভাবিক ভাবেই কুরআনের আদর্শের সাথে আমার আদর্শের মিল হয় না। সেজন্যই আমি বুকশেল্ফে শুধু মানবরচিত বই-ই রাখতে পছন্দ করি।

নোমান অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল মৃণালের দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে নিয়েছে অপার আক্ষেপে।

এ রুমের আলমারি নেই। পাশের রুমেও নেই সে বিষয়ে নিশ্চিত নোমান। বুকশেল্ফের পরদে পরদে সাহিত্যের সমাহার দেখার পর, আশপাশের উঁচু স্থানগুলির দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়া শেষ হলে নোমান মৃণালকে আরো একবার মনে করিয়ে দিলো অন্তত মুসলিম ঘরের সন্তান হিসেবে ঘরে কুরআনের একটা কপি রাখা উচিত। মৃণালের নিষ্ক্রিয়তা আর কুরআনের প্রতি খাপছাড়া মনোভাব বুঝতে পেরে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল নোমানের। তার মনে হলো এর চেয়ে বড় অন্যায় পৃথিবীতে আর হয় না।

নাস্তিক মৃণাল নয়, তবে সংশয়বাদী বটে। তাই বলে মুসলমান বংশভূত মানুষের ঘরে কুরআনের মুসহাফ থাকবে না? ওর জন্মের পর তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে আযান দিয়েছিলেন পিতা, মাতা স্বশব্দে বলেছিলেন আলহামদুলিল্লাহ।
বাল্যকালে খাইয়ে দেবার সময় বিসমিল্লাহ পড়েই তো প্রথম লোকমা মুখে তুলে দেয়া হয়েছিল। তারপরও ঘরে কুরআন রাখতে কীসের এত অনিচ্ছা?
দীর্ঘদিনের চেনা বন্ধুর প্রতি আন্তরিকতার জায়গাটুকু মলিন হতে লাগল। গান, বাদ্যযন্ত্রের মোহ যতই থাকুক, কুরআন না হয় নাই বা পড়তে জানুক, ঘরে কুরআন না রাখাটাকে কিছুতেই মন থেকে গ্রহণ করতে পারছিল না নোমান।

বলতে চাইছিল, অন্তত শ্রদ্ধাবোধ থেকে কি কুরআনের একটা কপি বুকশেল্ফের সর্বোচ্চ তাকে কাপড়ে পেঁচিয়ে রাখা যেতো না? কিন্তু বলতে পারল না। মনে এসে গেল তার নিজের ঘরের আলমারির উপরিভাগের চিত্র, যেখানে সবুজ কাপড়ে মোড়ানো আছে পবিত্র কুরআনুল কারীম; প্রাচীন ধুলায় ধূসরিত মরুভূমির বাস যেখানে। আজকালকার দ্বীনবিমুখ মানুষদের হৃদয়ের হাল যেমন।

স্নিগ্ধ কন্ঠস্বরে পাশ থেকে প্রমী বলে ওঠে, তার ঘরে কুরআন আছে। সপ্তাহে একদিন করে পড়ে। মনে হলো এ কথাটা বলে নোমানকে আশ্বাস দেয়ার অভিপ্রায় দেখাল। বোঝাতে চাইল সংগীত চর্চায় যুক্ত থাকলেও সে কুরআন ঘরে রাখে। ধুলা জমতে দেয় না খুব একটা, যত্ন করে পড়তেও জানে।
নোমান প্রমীর কথায় আগ্রহ না দেখিয়ে গিটারটা ব্যাগে ভরতে শুরু করল, মৃণাল ওর এমন হঠকারি স্বভাবে বিষ্মিত হয়ে উঠল। তাড়াহুড়ো করার ছেলে নোমান নয়, ধীর স্বরে গান গাওয়ার আবেশ ধরে রাখার জন্য সবসময় প্রশান্ত রাখে মগজ। হঠাৎ তাই অস্থির নোমানকে দেখে অবাক হতে বাধ্য হতে হলো। হাতটা কেটে গেছে, তা নিয়েও কোনো প্রকার চিন্তা নেই।

হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সন্ধ্যায় রিহার্সেলে আসবে বলে কথা দিয়ে গেল সে।
প্রমীর মনে হলো ওরও নোমানের পিছু পিছু যাওয়া উচিত, যদি এই ছুতোয় একটু কাছাকাছি আসা যায় তবে মন্দ হয় না। মনটা যে খারাপ হয়েছে নোমানের সে কথা প্রমী আন্দাজ করতে পারছে, কেন হয়েছে হয়তো সেটাও খানিকটা বুঝতে পেরেছে।

—আমিও যাই রে মৃণাল, সন্ধ্যায় আসবনি।

প্রমী বলল প্রফুল্ল স্বরে।

—কী রে, দুজনে একসাথে বের হচ্ছিস যে বড়!

মোটা আইলের ন্যায় ভ্রু উল্টিয়ে মৃণাল কথার ইশারায় জানতে চাইল একাকী সময় কাটানোর জন্য বের হলো কিনা দুজন। বিরক্তির রোদে পুড়ে খাক প্রমীর মেজাজ, বলে উঠলো;

—সবসময় উল্টাপাল্টা ভাবিস না তো। আমার কাজ আছে তাই যাচ্ছি।

তারপর দৌড়ে বের হয়ে গেল। মৃণাল হাসছিল ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে।

ছয় গজ হেঁটে গিয়ে অচেনা মানুষের বাদুড় রূপী ঝাঁকের সামনে পড়তে হলো।
কৌতুহলে আস্তে আস্তে পা এগিয়ে চোখ উঁচিয়ে ভীড় ঠেলে দেখতে পেল ফর্সা দাড়ির প্রভাত অবয়বের এক ফকিরের নিথর দেহ। মাথার বাম পাশ থেকে গলে পড়ছে মগজের তরল পদার্থ, ক্ষুধার্ত উদর হতে অঝরে ঝরছে জৈষ্ঠ্যের প্রখর দিনের গোধূলিবেলা। ডান হাতের কেটে ফালি হওয়া তালু থেকে গলগলিয়ে পড়ছে ভোরের তাজা সূর্যের লালিমা। সেই কেটে যাওয়া ডান হাতের আঙুল আঁকড়ে ধরেছে জীবনের শেষ সম্বল হিসেবে কাঠের রংচটা তসবীহ, তার অন্তিম নিঃশ্বাসে মিশেছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্’। বৃদ্ধ কাপড়ের ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে দশ টাকার একটা নোট, দুই টাকার পাঁচটা কয়েন।

নিউজটি শেয়ার করুন