হুমাইয়া ছালছাবিল ফাইজা
[এক]
গিটারের তার ছিঁড়ে ডান হাত কেটে বেজায় মর্মান্তিক দশা নোমানের, ফার্স্ট এইড বক্সের বেশিরভাগ তুলা সিদুরে মেঘে পরিণত হয়েছে। রক্তপ্রবাহ বন্ধ করতে তাই পরিষ্কার সুতি কাপড় দৌড়ে নিয়ে এলো প্রমী। সিদুরে মেঘের আবছা ছায়া ওর চোখের সাদা অংশেও স্পষ্ট হলো।
বন্ধু মৃণাল ওই চোখ দেখে কাটা হাতের তালুর যন্ত্রণায় কাতর নোমানকে রসিকতার সুরে বলল;
—হাত কাটার কষ্টটা প্রমীর চোখে লেগে চোখটা কেমন লাল হয়ে গিয়েছে, এখন কি ওর চোখে তুলা ধরে থাকতে হবে নাকি রে নোমান!
নোমান ব্যথার মাঝে বিরক্ত বোধ করল। মৃণালের এই এক স্বভাব। সবসময় প্রমীর সঙ্গে নোমানকে জড়িয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলাটা রীতিমতো রুটিন হয়ে উঠেছে তার।
—দেখতেছিস ব্যথা পাচ্ছি। এর মধ্যেও তোকে ফোড়ন কাটতে হবে? তোর এই এক স্বভাব আর গেল না।
নোমান বলল রেগে আগুন হয়ে।
—শোন! ফোড়ন কাটা হচ্ছে আমার জন্মগত অধিকার। এটা থেকে আমাকে দূরে সরাতে পারবি না।
জবাবে নোমান আর কিছু বলল না। মৃণালের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ল।
সুতি কাপড়ে হাতের তালু বেঁধে নোমান রাগে গজগজ করতে করতে বিল্ডিংয়ের পাশের ফার্মাসিতে ব্যান্ডেজ করতে চলে গেল। বাসায় ফার্স্ট এইড বক্স, ব্যান্ডেজের সরঞ্জাম নেই তাই অগত্যা বাইরে যেতেই হবে। নইলে ইনফেকশন হতে পারে।
যথারীতি দশ বিশ মিনিটের মধ্যে ফার্মাসি থেকে কিছু ওষুধপত্র হাতে ব্যান্ডেজ সমেত বাসায় ফিরল নোমান, ফিরে দেখে মৃণাল তার সাধের অ্যাকুস্টিক স্প্যানিশ গিটারের তার ঠিক করছে স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে। হাত থেকে রক্ত পড়ছে না দেখে প্রমী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে দূর থেকে। ওর চোখের রাঙা ভাবটা কমেছে অনেকটা। ও জানে কাছে গেলে নোমান অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে এজন্য ছুটে কাছে যাবার ইচ্ছে থাকলেও বাধ্য মেয়ে হয়ে দূরেই থাকল।
—ওটা ছাড়, আমি ফরিদের কাছ থেকে ঠিক করে নেবো।
ঘরে ঢুকে নোমান মৃণালকে বলল।
—আরেহ আমি জাস্ট সেট করে দিচ্ছিলাম, ফরিদ ছাড়া কি আর এ তারছিড়া গিটার সারানো সম্ভব।
—যা বলেছিস! ও বেটা ড্রাম বাজক না হয়ে মেকার হলে মন্দ হতো না।
—হুম তা ঠিক। ও কখন আসবে? তোকে জানিয়েছে?
—ওকে তো চিনিস, হঠাৎ দেখা দেয়া ওর কাছে 'আর্ট'। আটিস্টিক ভাইব বজায় না রাখলে ওর আবার ভাত হজম হয় না।
প্রমী খাতা-কলমে নতুন গানের লাইন তুলছে বর্তুলাকৃতির সোফায় বসে।
কিন্তু সুর মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছিল প্রতিবার। নোমানের ঘাড়ে স্বল্প পরিসরের ধাক্কা দিয়ে মৃণাল বুঝিয়ে দিলো মেয়েটার কাছে ওর যাওয়া উচিত।
সুরের সাথে প্রেমপর্বটাও শুরু করে করা দরকার। এসব উপদেশ শুনে নোমানের মনে অনীহার ডালপালা গজিয়ে উঠল, কেন যেন প্রমীর প্রতি হাজার চেষ্টা করেও প্রেম আনতে পারে না নোমান; অপারগ দৃষ্টিই পড়ে থাকে শেষে।
'অ্যাক্রোলিক' ব্যান্ডের মূল ভোকালিস্ট হিসেবে বেশ নামডাক কিনেছে নোমান। বন্ধু হিসেবে পেয়েছে বেশ কজন সংস্কৃতির সৃজনী ধারায় দীক্ষিত মানুষকে।
গানবাজনার প্রতি আলাদা আবেগ থেকে ভার্সিটির টপ সাবজেক্টের গৌরব ছেড়ে গানের দলে যোগ দিয়েছিল আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। সয়েছিল পরিবার-পরিজনের কটূক্তি। মেনে নিয়েছিল বাবা মায়ের বারোমাসি আষাঢ়ে নির্মিত মুখ। এতকিছুর পর জনপ্রিয় অ্যাক্রোলিক ব্যান্ডের মধ্যমণিতে রূপান্তরিত হওয়া নোমানের জন্য সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার মতোই অনন্য ছিল। গানের মায়া যেন নোমানের অন্তরের লালচে উপত্যকায় প্রবাহিত নদীর চারপাশটায় ফুল ফুটিয়ে দেয়। সারি সারি পুষ্পতরুর বহুল ঘ্রাণে প্রাণ ফিরে ফিরে আসে নোমানের ভোকালকর্ডে। নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে চোখ।
সামনেই রমজানের ঈদ। ঈদের রাতে অ্যাক্রোলিক ব্যান্ডের একটা বড় কনসার্ট হবার কথা রয়েছে টিএসসি চত্বরে। এই অধুনা গানের হুল্লোড় সফলতা পেলে নোমানের জনপ্রিয়তা গিয়ে ঠেকবে তুঙ্গে। দেশের অন্যতম সেরা গায়কের তকমাও পেতে পারে সে।
একারণে দিনরাত এক করে গিটারের টিউনিং, গানের লিরিক্স, সুর-তাল নিয়ে পড়ে আছে নোমান। মৃণালের বাড়ির পরিবেশটা বেশ নিরিবিলি, এখানে গানের দলের সবধরনের গুরুগম্ভীর কিংবা আড্ডার ছলে তৈরি হওয়া সংগীতের হাওয়া জড়ো হয়। সংস্কৃতিয়ানায় ভরাট হয়ে আছে মৃণালের চার দেয়াল। বুকশেল্ফের পরিচ্ছন্ন বইপত্র, টেবিলে দিনলিপির স্রোত। সবই গান তৈরির জন্য উপযোগী।
আজ ফরিদ, আনিকা আর রিসাদের আসতে একটু দেরি হবে বলে জানিয়েছে। তাই কনসার্ট কেন্দ্রিক মূল পরিকল্পনা এখনো শুরু হয়নি। তবে নতুন একটা গান উপহার দেবে কনসার্টে উপস্থিত দর্শকদের, সে সংলগ্ন গল্পগুজব আর টুকটাক লিরিক্স সাজানোর চেষ্টা চলছে।
চেষ্টাকে ভিন্ন মাত্রায় স্থানান্তরিত করতে নোমান প্রমীকে পরামর্শ দিলো 'বছর চারেক পর' কবিতার আবৃত্তি শুনতে। এ কবিতার মাঝে না পাওয়ার আবেগকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে, যা বেশ বিরল।
আবৃত্তির সাথে গানের কথার ঘন সম্পর্ক থাকে, কিন্তু তা খালি মনে বোঝা যাবে না। মনকে কাঁদিয়ে তবেই এ সম্পর্কের স্বাদ পাওয়া যায়।
বুকশেল্ফ পূর্ণ হয়ে আছে সমরেশ-বঙ্কিম-রবীন্দ্রের আদর্শে, খানিকটা হুমায়ুনি দমকা বাতাসও রয়েছে। আর আছে নানাবিধ প্রবন্ধমূলক বইয়ের হাতছানি, সবচেয়ে উপরের তাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবি ও নর্তকী এবং বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়। আজগুবি সংমিশ্রণ।
কিশোর রচনার সাথে বড়দের বই পাশাপাশি থাকাকে বড্ড বেমানান দেখায়। মৃণালকে এ কথা জানাতেই ফিক করে হেসে দিয়ে বলল তার মনে এই দুইয়েরই বাস। ক্ষেত্র অনুযায়ী আচরণ পাল্টে নেয়। এছাড়া মনে কিশোর ভাবনা আবার তারুণ্যের তাড়না দুটোই বহাল তবিয়তে থাকাটা আবশ্যকও বটে।
চলবে