১৬ই ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস, বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায়। ১৯৭১ সালের এই দিনটি আমাদের দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের স্বাক্ষর বহন করে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা শুধুমাত্র ভৌগোলিক সীমানার মুক্তি নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের পুনর্জাগরণের গল্প।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের পরিণতি। পাকিস্তানি শাসকদের বঞ্চনা, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল দেশের প্রতিটি স্তরের মানুষ।
আজকের এই দিনে আমরা স্মরণ করি সেই শহীদদেরকে, যাঁদের আত্মত্যাগে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন মুক্তির যোদ্ধা, যারা দেশের মাটিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। যারা এক বুক আশা নিয়ে লড়াই করে গিয়েছিলেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ডের লক্ষ্যে। কিন্তু ৯ মাসের সেই সংগ্রামের পর পরই তাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটে, দেশ চলে যায় পরিবর্তিত স্বৈরাচার আর ভিনদেশের কবলে। মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে পড়েন অবহেলিত। তার জ্বলন্ত প্রমান মেজর এম এ জলিল। যিনি ১৬ ই ডিসেম্বর পরবর্তী ভারতীয় সেনাবাহিনীর করা লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় প্রথমে গুম ও পরে মুজিবনগর সরকারের হাতে আটক হন।
সেই থেকে শুরু হয় এদেশের ভাগ্যাকাশে দূর্যোগের ঘনঘটা। যেখানে একটি সদ্য স্বাধীন দেশের আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাড়ানোর কথা ছিলো সেখানে শুরুতেই বিমর্ষ বদনে দেশের আপামর জনতা পরিলক্ষিত করে বিজয় হাতছাড়া হওয়ার দূর্ভাগ্যজনক দৃশ্য।
সেই শুরু। এরপর থেকে সময়ের পালাবদলে ১৬ ই ডিসেম্বর এসেছে প্রতিবছর। কিন্তু এ জাতির বাস্তবিক জীবনে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করা হয় নি। নানাবিধ অস্থিরতা, লুটপাট, ভিনদেশী আগ্রাসন, সীমান্তে নির্বিচারে হত্যা, পরিবারতান্ত্রীক রাজনীতির নির্মমতা কুঁড়ে কুড়ে খেয়েছে এদেশের প্রকৃত বিজয়ের আস্বাদ।
আজকের এই দিনে স্মরণ করছি শহীদ আবরার ফাহাদ কে, যিনি ভিনদেশের আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়ে এই প্রকৃত বিজয়ের আস্বাদ পেতে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন। বিশ্বজিৎ, চাপাতির কোপে ছিন্নভিন্ন দেহ নিয়ে কাঁদিয়েছিলো পুরো দেশকে। ফেলানীর সেই কাঁটাতারে ঝুলন্ত লাশ, অজস্র গুলিবিদ্ধ মরদেহ আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্বাক উপভোগ বিজয়ের বুকে কাঁটা হয়ে বিঁধেছে বারবার।
বিডিআর বিদ্রোহের নামে নির্মম গণহত্যা থেকে লাইট বন্ধ করে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়ে ৫ই মের সেই নির্মমতা বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছে ৩ অক্ষরের এই শব্দকে।
জুলাই আগস্ট এ তো প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্র জনতার উপর হত্যার মহা উৎসব পরিচালিত হয় আওয়ামী লীগ ও তাঁর দোসরদের মাধ্যমে। নির্মম গণহত্যা চালিয়ে শহীদ করা হয় হাজারো উদ্দীপ্ত তাজা প্রাণ কে।
সেই ক্ষত এখনো দগদগে ঘা হয়ে বিরাজ করছে বিজয়ের বুকে। কিন্তু প্রকৃত বিজয় কি এসেছে? বিজয়ের সন্ধিক্ষণের পূর্বমুহূর্তে বিডিআর গনহত্যা নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন না করার ঘোষণা জাতিকে আশাহত করেছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, বিগত ফ্যাসিস্ট সহযেগীদের পূনর্বাসন, বিতর্কিত উপদেষ্টা নিয়োগ সহ নানাবিধ কার্যক্রম প্রশ্ন তোলে বিজয় কি আসলে পুরোপুরি অর্জিত হয়েছে?
এসকল প্রশ্ন উত্তরের মাঝেই কাটছে আমাদের জীবন, এগিয়ে যাচ্ছি আমরা আগামীর পথে। আজকের এই দিনে আমাদের দৃপ্ত শপথ নিতে হবে দেশকে উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং ন্যায়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। দুর্নীতি, বৈষম্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করাই হবে প্রকৃত বিজয়ের মর্ম গাথা।
আসুন, এই দিনে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, একটি সমৃদ্ধ, সুশাসিত ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবাই মিলে কাজ করব।